দানবীর ড: আলাউদ্দিন আহমেদ

ড. আলাউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের দানশীল সমাজসংস্কারকদের মধ্যে একটি সুপরিচিত নাম। বিশেষ করে তাঁর জন্মভূমি কুষ্টিয়ার উন্নয়নে তাঁর অবদান অতুলনীয়।

দানবীর ড. আলাউদ্দিন আহমেদ

সভাপতি, উপদেষ্টা পরিষদ, গুরুকুল বাংলাদেশ

Philanthropist Dr. Alauddin Ahmed [ দানবীর ড: আলাউদ্দিন আহমেদ ]

আলাউদ্দিন আহমেদ – শৈশব

ড. আলাউদ্দিন আহমেদ ১৯৪৪ সালের ৩১ জুলাই কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার চাকারঘুয়া (বর্তমানে আলাউদ্দিন নগর) গ্রামে এক সমৃদ্ধ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিতা বাহার আলী ও মাতা তাহিরুন্নিসার পাঁচ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়।

আলাউদ্দিন আহমেদের দাদা ওয়াসিমউদ্দিন আহমেদ ছিলেন এলাকার খ্যাতনামা দানবীর ও সমাজসংস্কারক। মাত্র ৪/৫ বছর বয়সে আলাউদ্দিন পিতৃহারা হন। তবে সৌভাগ্যক্রমে তাঁর পিতৃতুল্য চাচা মোহাম্মদ আলী পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ছোট্ট আলাউদ্দিনসহ তাঁর ভাইবোনদের লালনপালনের দায়িত্ব পালন করেন।

 

আলাউদ্দিন আহমেদের শিক্ষা জীবন

আলাউদ্দিন আহমেদের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পরিবারের মক্তবে, মাত্র পাঁচ বছর বয়সে। পরবর্তীতে তিনি নন্দলাল প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। চাচা মোহাম্মদ আলীর তত্ত্বাবধানে ছোট্ট আলাউদ্দিন নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশোনা করেন এবং দ্রুতই শিক্ষকদের স্নেহ ও প্রশংসা অর্জন করেন।

মেধাবী ছাত্র ও প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদ হিসেবে তিনি ১৯৬১ সালে যশোর জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন। একই বছরে তিনি কুষ্টিয়া কলেজে (বর্তমানে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ) উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা শুরু করেন। যাতায়াতের নানা সমস্যার মাঝেও তাঁর পড়াশোনায় কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। তিনি ১৯৬৬ সালে বি.কম ডিগ্রি অর্জন করেন।

প্রতিষ্ঠিত Institute of Chartered Accountants in England and Wales-এ চার্টার্ড একাউন্টেন্সি পড়ার সুযোগ থাকলেও অনিবার্য কারণে তিনি বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে পারেননি। তবে তিনি দেশে থেকেই Shaha Majumer & Co.-তে চার্টার্ড একাউন্টেন্সি অধ্যয়ন করেন।

 

আলাউদ্দিন আহমেদের পেশাগত জীবন

১৯৬৯ সালে আলাউদ্দিন আহমেদ আয়কর অফিসার হিসেবে লাইসেন্স পান এবং পরের বছর তিনি আয়কর আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। অল্প সময়েই তাঁর সুনাম কুষ্টিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে বিস্তৃত হয়।

১৯৮০ সালে তিনি ঢাকায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম কেন্দ্রীভূত করেন এবং দ্রুতই দেশের শীর্ষ আয়কর পরামর্শকদের কাতারে জায়গা করে নেন। তাঁর ভদ্র ব্যবহার, দ্রুত মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, সততা ও পেশার প্রতি আন্তরিকতা তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। ধীরে ধীরে তিনি নিজস্ব ব্যবসা গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করেন—যার মধ্যে রয়েছে ময়দা মিল, দুগ্ধ খামার, কৃষি খামার, ফার্মাসিউটিক্যালস শিল্প ইত্যাদি।

তিনি নিম্নলিখিত পদগুলোতে দায়িত্ব পালন করছেন—

  • ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড

  • চেয়ারম্যান, আলো মাল্টিপারপাস কোম্পানি লিমিটেড

  • নির্বাহী পরিচালক, হেলথকেয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি

  • নির্বাহী পরিচালক, শিলাইদহ ডেইরি ফার্ম

  • ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আলাউদ্দিন নগর মাশরুম ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড

  • ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আলাউদ্দিন নগর ফিশারিজ লিমিটেড

  • নির্বাহী পরিচালক, অ্যাগ্রো প্রসেস ইন্ডাস্ট্রিজ

  • পরিচালক, গাজী এম্পোরিয়াম

  • পরিচালক, স্মরণিকা এন্টারপ্রাইজ

 

আলাউদ্দিন আহমেদ – সমাজকল্যাণ ও দাতব্য উদ্যোগ

জনহিতকর কাজের মানসিকতা ও স্থানীয় মানুষের কল্যাণে কিছু করার প্রবল ইচ্ছাই আলাউদ্দিন আহমেদের চরিত্রকে সংজ্ঞায়িত করে। মুক্তিযুদ্ধ তাঁর উপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং পরবর্তীতে তিনি কুমারখালী থানার যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাগুলো পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

জনশিক্ষার প্রবল সমর্থক আলাউদ্দিন নিজ এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার ফলে ১৯৭২ সালে চাকারঘুয়া প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৬ সালে তিনি নিজ গ্রামে চাঁদ চাকারঘুয়া ইবতেদায়ী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে তিনি চাকারঘুয়ায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অর্থায়ন করেন। ১৯৮২ সালে বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠা হয়। স্থানীয়রা কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এটিকে নামকরণ করে “আলাউদ্দিন আহমেদ হাই স্কুল”

ক্রমে আলাউদ্দিন আহমেদের সমাজকল্যাণ ও দাতব্য প্রকল্পগুলো আরও বৃহৎ ও বিস্তৃত হয়ে ওঠে। তিনি কুমারখালীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত কলেজটির জরাজীর্ণ ভবন পুনর্নির্মাণে অর্থায়ন করেন।

স্থানীয় হাজী মোহাম্মদ মোকাদ্দাস হোসেন ও বিশিষ্ট সমাজকর্মী গাজী হাবিবুর রহমানের অনুপ্রেরণায় আলাউদ্দিন আহমেদ পাশের গ্রাম বাঁশগ্রামে একটি কলেজ নির্মাণে অর্থায়ন করেন। কলেজটি ১৯৯৫ সালে চালু হয় এবং স্থানীয়রা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এর নামকরণ করে “আলাউদ্দিন আহমেদ কলেজ”

প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে আলাউদ্দিন আহমেদ নিজ গ্রামে একটি টেকনিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বর্তমানে কলেজটির নির্মাণকাজ চলমান।

তিনি স্থানীয় কৃষকদের জীবনমান ও জীবিকা উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৮২ সালে তাঁর উদ্যোগে “কৃষি, সেচ ও নিষ্কাশন প্রকল্প” চালু হয়। প্রকল্পের আওতায় প্রথমে পাঁচটি গভীর নলকূপ ও কিছু হালকা নলকূপ স্থাপন করা হয়। সঠিক সেচ নিশ্চিত করতে ৩,০০০ নিষ্কাশন ব্যবস্থা ও ১০,৫০০ কাঁচা জলাধার নির্মিত হয়।

তাঁর সক্রিয় প্রচেষ্টার ফলে চাকারঘুয়া ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ সম্ভব হয়েছে। অসংখ্য নলকূপ স্থাপন, পুকুর খনন এবং জলাধার নির্মাণের ফলে এখন স্থানীয় জনগণকে আর পানির অভাব নিয়ে ভুগতে হয় না। চাকারঘুয়া স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র তাঁর সামাজিক উন্নয়নমূলক দূরদৃষ্টির আরেকটি অনন্য উদাহরণ।

 

আলাউদ্দিন আহমেদের পরিবার

আলাউদ্দিন আহমেদের ভাইবোনদের মধ্যে রাবেয়া খাতুন ও শুকুরউদ্দিন শৈশবে মারা যান। তাঁর জীবিত ভাইরা হলেন শফিউদ্দিন আহমেদ ও ইয়ারউদ্দিন আহমেদ।

১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ আলাউদ্দিন আহমেদ সুরাইয়া বিলকিসকে বিয়ে করেন। সুরাইয়া ছিলেন স্থানীয় সমাজসেবক ও মানবতাবাদী গাজী হাবিবুর রহমানের কন্যা। বর্তমানে আলাউদ্দিন আহমেদ ও তাঁর পরিবার ঢাকার পূর্ব রামপুরায় বসবাস করছেন।