আন্তর্জাতিক যুব দিবস ২০১৭ [ International Youth Day 2017 ] শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ

শান্তি প্রতিষ্ঠায় তারুণ্য (Youth Building Peace)- শিরোনামে সময়োযোগী ও ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক যুব দিবস ২০১৭ উদযাপিত হচ্ছে। ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন শান্তিপূর্ণ বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি কী হবে না ঠিক করে দেন ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং কারো সাথে শত্রুতা নয়। এই অসাধারণ অঙ্গিকার থেকেই আমরা জাতির জনকের শান্তির প্রতি একনিষ্ঠ আগ্রহের ও অবিচলতার পরিচয় পাই।

তরুণ বয়সেও জাতির জনকের রাজনৈতিক আদর্শে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা, বর্ণবাদবিরোধিতা, বর্ণবাদবিরোধিতা ও শান্তির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার পরিচয় পাওয়া যায় যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রতিফলিত হয়েছে। ২০১৭ সালের আন্তর্জাতিক যুব দিবসের প্রতিপাদ্যের সাথে আমাদের রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি যা জাতির জনকের দেখানো স্বপ্ন তার সাথে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর দেখানো দিক নির্দেশনার ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশ বিশ্ব শাস্তি সমুন্নত রাখতে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

যুব দিবসের তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতার একটি বিশেষ দিক হচ্ছে জাতি সংঘের শান্তি কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের শক্তিশালী উপস্থিতি। এ যাবৎকালে জাতিসংঘের শান্তি মিশনগুলোর মধ্যে ৭০টির মধ্যে ৫৪টিতে অংশ নেয় বাংলাদেশ, বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট ১,৪১,৭২৬ জন সেনা সদস্য বিশ্ব শান্তি রক্ষার কাজে জাতিসংঘ মিশনে গিয়েছেন। বর্তমানে বিশ্ব শান্তি রক্ষার কাজে নিয়োজিত জাতিসংঘের মিশনে অবদান রাখার তালিকায় বাংলাদেশ ৪র্থ বৃহত্তম কন্টিনজেন্ট প্রেরণকারী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত।

 

যুব দিবস ২০১৭ এর পটভূমি :

৯ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত ২২৫০ নং প্রস্তাবে এটি স্বীকার করে নেয়া হয় যে তারুণ্য আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও শান্তি বজায় রাখতে ও উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধি করতে গুরুত্বপূর্ণ ও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই সিদ্ধান্তে আরো বলা হয় যে নিরাপত্তা ও শান্তি রাখতে ও উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধি করতে যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয় তার পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে অংশগ্রহণ, সুরক্ষা, নিবারণ, অংশীদারিত্ব ও বিচ্ছিন্নকরণ এবং পুনর্বাসন।

এই প্রস্তাবে সকল সদস্য রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানানো হয় যেন তারুণ্যকে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সাথে আরো জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করা হয় এবং বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে তারণ্যকে শান্তি প্রক্রিয়ায় অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। বিশ্বায়নের এই সময়ে নিরাপত্তা পরিষদের এই সিদ্ধান্তটি একটি মাইলফলক কেননা আমরা দেখছি বস্তুগত উৎকর্ষ সাধন করতে গিয়ে আমরা শাস্তিকে অন্যান্য ধারণার মত গুরুত্ব দেইনি এবং এখানে ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ হিসেবে তারুণ্যের অবদানকে স্বীকার করিনি।

এই স্বীকৃতি তাই ঐতিহাসিক ২২৫০ নং প্রস্তাবকে উদ্ধৃত করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ২০১৬ সালে আরো একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয় বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যেখানে জাতিসংঘের ‘পিস বিল্ডিং’ কাঠামোর পুনর্বিবেচনা প্রসঙ্গে তারুণ্যের ভূমিকাটিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নিরাপত্তা পরিষদে নেয়া ২২৮২ নং প্রস্তাবে বলা হয় সংঘাত নিবারণ ও সমাধানে তারুণ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে যা টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সফল পিস বিল্ডিং ও পিস-কিপিং প্রচেষ্টার কেন্দ্রে। এই প্রস্তাবেও সকল সদস্য রাষ্ট্রের কাছে অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আবেদন জানানো হয়।

 

শান্তির ধারণাঃ পজিটিভ ও নেগেটিভ পিস :

মানব সভ্যতার ইতিহাসে যেসব মানবীয় গুণাবলীকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এদের মধ্যে শাস্তি অন্যতম। তবে অন্যান্য মানবসৃষ্ট ধারণার মতই এই ধারণাটিরও একটি সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞায় একমত হওয়া দুস্কর। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাছে শান্তির ধারণা বিভিন্ন। বোঝাপড়ার বৈচিত্রতার কারণে শাস্তির ধারণাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছে। সাদামাটাভাবে বলতে গেলে শাস্তি হলো অনৈক্য, সহিংসতা ও যুদ্ধের অনুপস্থিতি হিসেবে দেখলে তা খুবই সংকীর্ণ হয়। অ্যালবার্ট আইন্সটাইন এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “শাস্তি শুধু যুদ্ধের অনুপস্থিতিই নয় বরং ন্যায়বিচার, আইন, শৃঙ্খলার উপস্থিতি, অল্প কথায় বললে সরকারের অস্তিত্ব থাকাটাই শান্তি”। শুধু যুদ্ধের অনুপস্থিতিতিই শাস্তি নয়, শাস্তির ধারণা আরো বৃহৎ সর্বব্যাপী ও বহুমাত্রিক।

প্রসঙ্গত শান্তির ধারণা দুভাবে দেখা হয়, পজিটিভ পিস ও নেগেটিভ পিস। এই শব্দদ্বয়ের ধারণা প্রথমে দেন শাস্তি গবেষণার অন্যতম পুরোধা ইয়োহান গালটুং ১৯৬৪ সালে জার্নাল অব পিস রিসোর্সের প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে। পজিটিভ ও নেগেটিভ পিসের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টি ১৯৫০ এর দশকের সময়ে তৈরি হয় যখন শান্তি-গবেষণার বিষয়টি কেন্দ্রীয় মনোযোগ ছিল সরাসরি সহিংসতার দিকে, বা আক্রমণ এবং যুদ্ধের মত ধারণার দিকে বেশি। শাস্তি গবেষণার বিষ্ণুটি তখন উত্তর আমেরিকানদের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত ছিল।

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গালটুং ১৯৬০ এর দশকে শান্তি ও সহিং সতার ধারণাকে বিস্তৃত করেন এবং এদের সাথে পরোক্ষ বা কাঠামোগত সহিংসতার কথা যুক্ত করেন। গালটুং এর এই অবদান তখনকার শান্তির ধারণা বলতে যা বুঝানো হতো তাকে ভিন্নভাবে ভাবার সুযোগ তৈরি করে দেয়। সহিংসতার এই পরিবর্ধিত সংজ্ঞার ফলে মুদ্রার অপর পিঠে আমরা শান্তির পরিবর্ধিত সংজ্ঞা পাই। গালটুং এর মতে নেগেটিভ পিস হলো, “সহিংসতার বা যুদ্ধের অনুপস্থিতি”, এবং পজিটিভ পিস হলো “মানব সমাজের সংহতি”।

শান্তি ও সংঘর্ষ গবেষণায় মাহাত্মা গান্ধির অবদানও উল্লেখযোগ্য। গান্ধির মতে সত্য ও স্থায়ী শান্তি তখনই আসবে যখন সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে। গান্ধির শান্তি ও অহিংসতার সাথে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে ন্যায় বিচার, উন্নয়ন ও পরিবেশের। ১৯০৯ সালে লেখা গান্ধির থেকে জানা যায় উন্নয়নের আধুনিক মডেলগুলো সহজাতভাবে সহিংস। শান্তির ধারণায় গান্ধির অবদান সবচেয়ে বেশি অহিংস ধারণার উপর বিস্তৃত কাজের কারণে এবং সর্বপ্রথম অহিংস নীতিকে ব্যক্তিকেন্দ্রকতা থেকে সমাজ কেন্দ্রিকতা ও রাজনৈতিক দর্শনে উঠিয়ে নিয়ে আসার জন্য।

 

গ্লোবাল পিস ইনডেক্স ২০১৭ মতে পজিটিভ পিসের স্তরসমূহ নিম্নরূপঃ

  • উন্নত মানব সম্পদ গঠন
  • প্রতিবেশির সাথে সুসম্পর্ক
  • অন্যের অধিকারকে সম্মান করা
  • দুর্নীতির মাত্রা কমিয়ে আনা
  • তথ্যের অবাদ প্রবাহ
  • ব্যবসার উন্নত পরিবেশ
  • কার্যকরি সরকারের উপস্থিতি
  • সম্পদের সুষম বণ্টন

পজিটিভ পিসের ধারনাটি যুদ্ধ, সংঘাত, অন্যায়ের মূল কারণগুলো দূল করার সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত এবং এর সাথে সাথে সচেতনভাবে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ার প্রত্যয়ের সাথে সম্পর্কিত যেখানে এই প্রতিশ্রুতিগুলো প্রতিফলিত হয়। পজিটিভ পিস সকল সজিব সত্তার সাথে সংযোগের কথা বলে। শাস্তি তখনই আসবে যখন মানুষ তাদের মধ্যে বিরাজমান সংঘাতকে অহিংস উপায়ে সমাধান করার এবং একসাথে কাজ করে তাদের সম্মিলিত জীবণযাত্রার মান বৃদ্ধি করার পথ তৈরি করবে। এই লক্ষ্যে তারুণ্যের শক্তি সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

 

কেন শান্তি অপরিহার্য :

শাস্তি সহজাত, এটি একটি স্বাভাবিক অবস্থাকে প্রকাশ করে, সংঘাত নয়। শাস্তি তাই অপরিহার্য, তবে এটি অর্জন করা দুস্কর। তিনটি কারণে শান্তি অপরিহার্য বলে বিবেচনা করা যায়। প্রথমত, আমরা জানি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সংঘাত আজকাল নিজ নিজ সীমান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, এগুলোর সুদূরপ্রসারী ও গভীর প্রভাব অন্য অঞ্চলেও পড়ে। উন্নত বিশ্ব সম্প্রতি যে শরণার্থী সমস্যার সম্মুখীন তার মূলে রয়েছে শরণার্থীদের নিজ ভূমে যুদ্ধ, সহিংস সংঘাত ও অনিরাপত্তা। জাতিসংঘের ইউএন এইচসিআর এর অনুমান মতে ২২.৫ মিলিয়ন মানুষ আজ শরণার্থী যাদের অর্ধেকের বয়স ১৮ বছরের নীচে।

শুধু মানবিক নয় যুদ্ধ, সহিংস সংঘাতের আর্থিক ক্ষতিটিও পর্বতসম গ্লোবাল পিস ইনডেক্স ২০১৭ এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালে ১৪.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বায় হয়েছে যুদ্ধের কারণে সামরিক খাতে, যা বিশ্বের মোট জিডিপির ১২.৬ শতাংশ। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই আফগানিস্তান, ইরাকের যুদ্ধে ৪.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে।

দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ যুদ্ধ, সহিংসত সংঘাতে মূলে রয়েছে অসাম্য, অন্যায় ও বঞ্চনা। অক্সফোভের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের আটজন শীর্ষ ধনীর কাছে যতটুকু সম্পদ রয়েছে তা বিশ্বের ৩৬০ কোটি দরিদ্র মানুষের সম্পদের সমান। এই তথ্য থেকেই বৈশ্বিক বৈষম্যের চরিত্রটি বুঝা যায়। অধিকাংশ রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে প্রথমেই সামরিক উপায় অবলম্বন করার কথা চিন্তা করা হয়, অথচ এর দ্বারা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সুশাসনজনিত সমস্যাগুলোর সমাধানে পৌঁছানো কিংবা স্থায়ী শাস্তি আনা কখনও সম্ভব হয় না। এ ধরনের সমস্যাগুলোর কখনই সামরিক উপায় অবলম্বন কোন টেকসই ও স্থায়ী শান্তিপূর্ণ সমাধান এনে দেয় না।

তৃতীয়ত, যুদ্ধ, সহিংস সংঘাতের কারণে প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংস হয় ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। কোলিয়ার হোফলার এবং ফিয়ারোন-লাইটিন এর গবেষণা মতে যুদ্ধ ও সংঘাতের সাথে মাথাপিছু আয়ের ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। যুদ্ধ ও সহিংস সংঘাতের ফলে সৃষ্ট পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে জীবনযাত্রার মানও কমে যায়। গ্লোবাল পিস ইনডেক্স এর ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রতি ১ ডলার শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করা হলে সহিংস সংঘাতে ১৬ ডলার ব্যয় কমবে। সভ্যতার উন্নয়নে ও একটি সহজাত প্রক্রিয়া হিসেবে শাস্তি অপরিহার্য হলেও এর অর্জনে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।

শান্তি প্রতিষ্ঠায় এই প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণঃ সহিংস সংঘাত, উগ্রবাদ, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে শক্তির রাজনীতি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আধিপত্যের লড়াই, দ্বন্দ্বের বহুমাত্রিকতা, দারিদ্র্য, বৈষম্য, অনুন্নয়ন, বিচ্ছিন্নকরণ, অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি, পরিবেশ বিপর্যয়, ভারসাম্যহীন সমাজ সৃষ্টি, গোষ্ঠীর সার্থকে মানবতার ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া ইত্যাদি।

 

শান্তির অপরিহার্য অনুধাবনে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় কয়েকটি বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে :

  • বিশ্বের ইতিহাসে তরুণ প্রজন্ম বর্তমানে সর্ববৃহৎ এবং সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত দেশগুলোতে অধিকাংশ জনগণই তরুণ প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত।
  • শিক্ষা ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুবদের অংশগ্রণে বাধা সমাজে স্থায়ী শান্তি ও সমঝোতার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
  • স্থায়ী শান্তি, ন্যায়বিচার ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় যুবাদের সক্রিয় ভূমিকা রাখা জরুরি।
  • অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি কাঠামোর উপস্থিতিতে যুব সমাজ কর্তৃক ড্যামোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড এর পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ করা যেতে পারে যা স্থায়ী শাস্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।

জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক যুব দিবসকে সামনে রেখে শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে বহুমাত্রিক উপাদান বিবেচনা করে। বিভিন্ন উপাদানের দিকে তাকালে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এবং কর্মকাণ্ডের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা যে অতোপ্রতোভাবে জড়িত এবং শান্তির অপরিহার্যতা উপলব্ধি করা যায়।

 

শান্তি প্রতিষ্ঠা ও ভালগা বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষিত :

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় যে চ্যালেঞ্জগুলোর কথা পূর্বে বলা হয়েছে তা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের যুবনীতিতে সেই চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবেলা করার কথা বলা হয়েছে। এই লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন কার্যক্রমও নেয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, শেখ হাসিনা জাতীয় যুব কেন্দ্রের মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রশিক্ষণ কোর্সসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোর্সগুলো হচ্ছে খুব নেতৃত্ব বিকাশ ও যুব সংগঠন ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্স, লাইফ স্কীল এন্ড ফ্যামিলি লাইফ এডুকেশন বিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্স, দ্বন্দ্ব নিরসন ও সমঝোতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্স, নাগরিক দায়িত্ব ও গোষ্ঠী উন্নয়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্স ইত্যাদি।

জাতীয় যুবনীতি ২০১৭ এ যে বিষয়াবলীর অবতারণা করা হয়েছে তা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়। জাতীয় যুবনীতি ২০১৭ তে যেসব উদ্দেশাগুলোকে পূরণ করার কথা বলা হয়েছে তার অধিকাংশই পজিটিভ পিসের স্তরগুলোর সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত, যেমন:

  • যুবদের ইতিবাচক মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা।
  • সম্ভাবনা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা।
  • যুবদের মানব সম্পদে পরিণত করা।
  • মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
  • যোগ্যতানুযায়ী পেশা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ।
  • অর্থনৈতিক ও সৃজনশীল কর্মোদ্যোগকে উৎসাহিত করা।
  • ক্ষমতায়নের মাধ্যমে যুবদের সক্রিয় ভূমিকা পালনে সক্ষম করে তোলা।
  • স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার যুবদের সম্পৃক্ত করা।
  • যুবসমাজকে সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল করে তোলা।
  • বিভিন্ন গঠনমূলক কাজে স্বেচ্ছাসেবী হতে যুবাদের উৎসাহিত করা।
  • জীবনাচরণে মতাদর্শগত উন্নতা ও আক্রমণাত্মক মনোভাব পরিহারে যুবদের উদ্বুদ্ধ করা।
  • যুবদের মধ্যে উদার, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও বৈশ্বিক চেতনা জামত করা।

এই উদ্দেশ্যগুলোকে জাতীয় যুবনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠান জন্য বাংলাদেশের অঙ্গিকারকে প্রকাশ করে।

জাতীয় যুবনীতি ২০১৭ তে কিছু বিশেষ খাতেক অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে ক্ষমতায়ন, সুশাসন, স্বাস্থ্য ও বিনোদন, টেকসই উন্নয়ন, সুষম উন্নয়ন, সুস্থ সমাজ বিনির্মান, বিশ্বায়ন ইত্যাদি। যদিও শান্তিকে এই নীতিতে নামোল্লেখ করে অগ্রাধিকার দেয়া হয়নি তথাপিত এই খাতগুলোর অধীনে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের জন্য যা করণীয় তা বলা হয়েছে। এছাড়া যুবনীতিটিতে সরকার প্রান্তিক, পশ্চাদপদ ও অসহায় যুবদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তার অঙ্গিকার ব্যক্ত করা হয়েছে। এই যুবনীতিটি একটি ইনক্লুসিভ যুবনীতি হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে।

যুবনীতিতে ২০১৭ যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে যা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্মাণে সহায়ক সেগুলোর কয়েকটি নিন্মরুপ:

  • যুবদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে মানবিক, নৈতিক ও আত্মিক উন্নয়নমূলক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জবাবদিহিতামূলক নেতৃত্ব, গণতান্ত্রিক চর্চা, দুর্যোগে ত্যাগের মানসিকতার চর্চা উৎসাহিত করা
  • নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সহমর্মিতা, দায়িত্ববোধ, গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব ও শৃঙ্খলাবোধ তৈরি করা
  • সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ও নিরাপত্তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া
  • মানবাধিকার সুরক্ষা ও প্রসার
  • টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে লক্ষ্যমাত্রাসমূহ সম্পর্কে যুবদের সচেতন করা ও সম্পৃক্ত করা, পরিবেশ সম্পর্কিত সচেতনতা ও শিক্ষাবৃদ্ধি করা
  • সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে সুষম সুযোগ প্রদান, সুষ্ঠু সম্পদ বণ্টন, বিশেষ সহায়তা কার্যক্রম প্রতিনিধিত্বের সুযোগ তৈরি করা
  • সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে যুবদের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সহিষ্ণুতা ও ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি, পরমত সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধাশীলতা সৃষ্টি করা
  • সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে যুবদের মধ্যে দেশপ্রেম ও নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া, আন্তর্জাতিক মানবিক বিষয়াবলি সম্পর্কিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার শিক্ষা দেয়া, আন্তর্জাতিক অপরাধ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো, ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া, বিশ্বজনীন ও সামগ্রিক নিরস্ত্রীকরণের সচেতনতা বাড়ানো।

 

উপরোল্লিখিত যুব নীতির আলোকে মাঠ পর্যায়ে দেখা যায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কর্তৃক যুব সমাজের জন্য দেশে ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ্যণীয়। ২০০৯ সাল থেকে দেশে যুব শক্তিকে ব্যবহারের জন্য আত্মকর্মসংস্থান, পেশা ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও সিটি কর্পোরেশন পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ সকল কর্মকাণ্ডে যুব সমাজকে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বেকার যুবদের প্রশিক্ষণের অধীনে ১ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ৩০ জুন ২০১৬ পর্যন্ত মোট ১৭,৫২,৫১৩ জনকে প্রশিক্ষীত করা হয়। এই একই সময়ে মোট ৪,৬৩,৯৮৫ জন প্রশিক্ষিত যুবদের আত্মত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। ইট নিঃসন্দেহে একটি বিরাট অর্জন। অন্যদিকে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে বিদ্যমান শক্তিশালী এনজিও সেক্টর, নাগরিক সমাজ ও প্রাইভেট খাত কর্তৃক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুব সমাজের এক ধনের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষুদ্র ঋণ, পরিবেশ, প্রশিক্ষণসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে আমরা দেখি যে এই যুবনীতিটি একটি যথার্থ ও সময়োপযোগী নীতি। জার্মানীর যুবনীতি অনুযায়ী, সমাজে জার্মান যুবাদের প্রয়োজন ও তাদের চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে, সমাজের উন্নয়নে স্থায়ী ও টেকসই অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে।

জাপানের জাতীয় যুবনীতিতে স্কুলের শিক্ষাকে যুব উন্নয়নের জন্য উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে, বিপদগ্রস্ত যুবাদের বিশেষ সহায়তা দেয়া হবে বলা হয়েছে। গৃহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের মাঝে মেলবন্ধন বা সম্পর্ক পুনঃনির্মাণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও গুরুত্ব সহকারে স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, যোগাযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে জাপানের জাতীয় যুবনীতিতে।

মালয়েশিার যুবনীতিতে উচ্চ নৈতিক ও দার্শনিক শিক্ষার গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে, তরুণদের দায়িত্বমীল দেশপ্রেমিক ও স্বাধীন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য জোর দেয়া হয়েছে। এছাড়াও আরো যে দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে মালয়েশিয়ার যুবনীতিতে তা হলো তরুণদের উন্নয়নের জন্য জ্ঞানের বিকাশ হচ্ছে প্রথম এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণগত উন্নয়ন হচ্ছে দ্বিতীয় অবশ্য অনুসরণীয় কৌশল। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নেটওয়ার্কিংকেও গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে এখানে।

আমরা আমাদের দেশের যুবনীতির দিকে তাকালে দেখতে পাবো যে, এর সাথে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের যুবনীতির মিল রয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যুবসমাজের উন্নয়নে যেসব কর্তব্য পালন করা হয় বেস্ট প্রারিস হিসেবে সেগুলো আমাদের দেশের যুবনীতিতে অনুসরণ করার অঙ্গিকার ব্যক্ত করা হয়েছে।

 

শাস্তি প্রতিষ্ঠায় যুব সমাজের সম্পৃক্ততা চ্যালেঞ্জসমূহ :

আমাদের যুব সমাজকে শান্তির পথে পরিচালনা করা খুবই চ্যালেঞ্জিং কাজ। এর জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অঙ্গনে যে অঙ্গিকার, আত্মীকরণের চেষ্টা ও বিপুল কর্মজজ্ঞের দরকার তা অনেকাংশেই অনুপস্থিত, বা যা রয়েছে তা অপ্রতুল। যুবনীতিটি নিঃসন্দেহে একটি বৃহৎ সময়োপযোগী ডকুমেন্ট কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য যে বাস্তব এবং মাস্টার পরিকল্পনা দরকার তা যুবনীতিতে উল্লেখ করা হয়নি। যুবনীতিতে শান্তিকে একটি বিশেষ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত খাত হিসেবে স্থান দেয়া যেত তাতে যুবনীতির মূল উদ্দেশ্য আরো বেগবান হতো।

শান্তি প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জকে তিনটি প্রধান শ্রেণিতে বিভাজিত করা যায়। প্রথম, জাতীয় নীতিগত একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় নীতিতে শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনাই যে মূল উদ্দেশ্য তা পরিস্কারভাবে প্রতিফলিত হয়নি। জাতীয় নীতিসমূহ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখবো এই বিষয়ে আমাদের আরো উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে যেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠাকে একটি কেন্দ্রীয় অবস্থানে রেখে বিভিন্ন উদ্দেশ্য পূরণ করা যেতে পারে। জাতীয় নীতিসমূহতে শান্তিকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত একটি খাত হিসেবে দেখাতে হবে। জাতীয় শিক্ষা নীতি, যুব নীতি, সংস্কৃতি নীতি, শ্রম নীতিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে না। এসব নীতিতে পরোক্ষভাবে বা খুব বিক্ষিপ্তভাবে শাস্তির কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশের যুব নীতির সম্পূর্ণ এবং হৃদয়ঙ্গম বাস্তবায়নের জন্য একটি বৃহৎ কর্মপরিকল্পনা দরকার যার উপস্থিতি দৃশ্যমান নয়। দৃশমান একটি কর্মপরিকল্পনা এবং দৃশ্যমান পরিবর্তন না থাকলে এই নীতিটি তার অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে না। এই নীতির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ের জন্য স্টিয়ারিং কমিটির কার্যাবলীর বিশদ বিবরণ সম্পর্কে জনগণকে বিশেষত যুব সমাজকে অন্তর্ভুক্তি করার কৌশল বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়নি।

দ্বিতীয়ত, শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুবদের অন্তর্ভুক্তিকরণে প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সমাজের বিভিন্ন ফরমাল ও ইনফরমাল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এগুলোতে প্রধান উপজীব্য হিসেবে শান্তিকে দেখা হয় না। এসব প্রতিষ্ঠানের এজেন্ডা বিভিন্ন রকমের হয়, যেখানে হয়তো খুব বিক্ষিপ্তভাবে শান্তির কথা এসেছে তবে মিশন, ভিশন হিসেবে কখনও শাস্তিকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা দেয়া হয়নি বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খুবই ক্ষুদ্র উদ্যোগের মধ্য দিয়ে শান্তিকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালিয়েছে যা অপ্রতুল।

বাংলাদেশের বেসরকারি, ব্যবসায়িক, দাতব্য প্রতিষ্ঠান কিংবা নাগরিক সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও প্রত্যক্ষভাবে কখনো শাস্তি প্রতিষ্ঠাই যে মুখ্য উদ্দেশ্য তা বলা হয়নি। শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এইসব প্রতিষ্ঠানে উপেক্ষিত থেকেছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কম গুরুত্ব পাওয়া একটি বিশ্বজনীন ও সাধারণ চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে শান্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করার মত বিবেচননা করবেন এরকম মানুষের সংখ্যারও অপ্রতুলতা রয়েছে আমাদের দেশে।

তৃতীয়ত, শান্তি প্রতিষ্ঠায় যে সব কর্মসূচী, প্রশিক্ষণ, শিক্ষামূলক কার্যক্রম দরকার তার অপ্রতুলতা রয়েছে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানের সাধারণ কার্যক্রমগুলোতে শাস্তির বিষয়টি প্রতিফলিত হয় না। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ, এনজিও, নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে শান্তির বিষয়টি উপেক্ষিত থেকেছে এতদিন। এতদিন এসব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এজেন্ডাই ছিল শাস্তি ভিন্ন অন্ন কিছু যেমন দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের এনজিওগুলোর ফোকাস ছিল দারিদ্র্য বিমোচন ও পরিবেশ। আবার সরকারি কার্যক্রমের অপ্রতুলতার উদাহরণ দিতে গেলে উল্লেখ করা যায় যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ও যুবদের অংশ গ্রহণ নির্ভর মাত্র একটি প্রশিক্ষণ কোর্স শেখ হাসিনা জাতীয় যুব কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রদান করা হয় যা এখনকার সমাজ ব্যবস্থায়

বাংলাদেশে তরুণদের মাঝে দ্বন্দ্ব, সংঘাত বিষয়ক জ্ঞানের অপ্রতুলতা, সচেতনতার অভাব রয়েছে, এর কারণে আবার শান্তির শিক্ষা বা পিস এডুকেশন অনেকাংশেই সমাজের বিভিন্ন স্তরে পৌছানো সম্ভব হয় না। পাঠ কার্যক্রমে পিস এডুকেশনের অন্তর্ভুক্তি একটি চ্যালেঞ্জ কেননা আমরা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৈষয়িক উৎকর্ষ সাধনের উপর বেশি জোর দেয়া হয় কিন্তু এর সাথে মানবিক গুণাবলীর বা নৈতিক গুণাবলীর বিষয়টির উপর জোর দেয়া হয় খুব কম। সমাজে তাই একটি কাঠামোগত টেনশন রয়ে গেছে।

আমরা জানি আমাদের দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ যুব এবং আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডও রয়েছে, এগুলোর সুফল ভোগ করতে চাইলে আমাদের তরুণদের সম্পৃক্ত করতে হবে, সহিংস মনোভাব থেকে দূরে রাখতে হবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তরুণদের সম্পৃক্ত না করাটা বা পিস একটিভিজমের অপ্রতুলতা এবং তা বিভিন্ন নীতিতে প্রতিফলিত না হওয়াটা একটি চ্যালেঞ্জ।

 

ভবিষ্যত করণীয় :

বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজের ভূমিকার বিষয়টিকে সঠিক কাঠামো ও দিক নির্দেশনা পেতে হলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২২৫০নং প্রস্তাবটি বিবেচনা করতে হবে। এই প্রস্তাবে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যুব সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে।

২০১৬ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ২২৮২নং প্রস্তাবে এক্ষেত্রে যুবদের ভূমিকার ব্যাপারটি নতুনভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে বিদ্যমান যুব সংক্রান্ত নীতি ও বার্যক্রমে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। সরকারি ও বেসরকারি খাত কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত পদক্ষেপ, প্রচেষ্টা কিংবা কর্মসূচী অপ্রতুল।

সমাজে ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিরাজমান প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত দ্বন্দ্ব সংঘাত, দ্বন্দ্ব নিরসন, দ্বন্দ্ব ব্যবস্থাপনা কিংবা দ্বন্দ্ব প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যুবাদের বিশেষ ভূমিকার বিষয়টি অনেকটা উপেক্ষিত। সমগ্র বিশ্বসহ বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের ছোবল, উগ্রবাদ মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতার বিস্তার একটি বড় উদাহরণ। পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়,অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি ও অপরাধ প্রবণতা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে বিরাজ করছে।

আন্তর্জাতিক যুবদিবসের প্রতিপাদ্যকে বিবেচনায় রেখে রূপকল্প ২০২১, উন্নত বাংলাদেশ ২০৪১, সর্বোপরি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে কিছু সুপারিশ কিংবা ভবিষ্যত করণীয় ভাবা যেতে পারে :

১.জাতীয় যুবনীতি ২০১৭ এর ভিশন অনুযায়ী নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন আধুনিক যুবসমাজ পড়ার লক্ষ্যে যুবনীতির সঠিক ও সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন দরকার। জাতীয় যুবনীতি ২০১৭ এর ১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্মাণে যুবাদের অন্যতম স্তন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করার বিষয়টিকে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন অঙ্গনে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্মাণের জন্য এ্যাকশন প্লান তৈরী করতে হবে এছাড়াও যুবনীতিতে শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্মাণে সহায়ক বিভিন্ন গুণাবলি ও উদ্দেশ্যসমূহকে যেমন ক্ষমতায়ন, সুশাসন, নাগরিক অংশগ্রহণ, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার সুরক্ষা ও প্রসার, টেকসই ও সুষম উন্নয়ন ইত্যাদিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করতে হবে । বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এসবকে লক্ষ্য রেখে কার্যপ্রণালী ঠিক করতে হবে এবং এজেন্ডায় গুরুত্ব সহকারে জনপ্রিয় করতে হবে।

২. টেকসই ও সুষম উন্নয়নে যেন যুবদের অংশগ্রহণ সর্বোচ্চ থাকে, উন্নয়ন যেন সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক হয় সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। বস্তুগত উন্নয়ন করতে গিয়ে যেন শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের লক্ষ্য থেকে যুবারা দূরে না সরে যায় তার জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে যুবসমাজে।

৩. ক্রমবর্ধমান মৌলবাদ, উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদকে মোকাবেলার জন্য যুবসমাজকে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে । উন্ন জঙ্গিবাদী গোষ্ঠি ও জঙ্গিবাদকে মোকাবেলার জন্য যুব সমাজকে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। উগ্র জঙ্গিবাদী গোষ্ঠিসমূহের অধিকাংশ সদস্যরা যেমন তরুণ, আবার এর অন্যতম শিকার তারাই। জাতীয় কর্মকাণ্ডে বিশেষ করে যুব সংক্রান্ত পরিকল্পনা ও কর্মসূচীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় জিরো টলারেন্স নীতির প্রতিফলন ঘটাতে হবে।

৪. বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাঙ্গনে শান্তির শিক্ষা বা পিস এডুকেশনের বিষয়টি চর্চা বাড়াতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তথা প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন স্তর পর্যন্ত শান্তির শিক্ষা বা পিস এডুকেশনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্তি করতে হবে- পাঠক্রমে। শান্তির শিক্ষায় বিভিন্ন মহৎ ব্যক্তির অবদানকে উপস্থাপন করতে হবে যেন যুবা এবং তরুণ প্রজন্ম অনুপ্রেরণা পায় এবং নিজেদের জীবনে তা কাজে লাগাতে পারে।

৫. দ্বন্দ্ব নিরসন ও সমঝোতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্সের মতন আরো শান্তিকে ফোকাস করে বিভিন্ন কোর্স যুবদের জন্য আয়োজন করতে হবে সেখানে পজিটিভ পিসের স্তম্ভসমূহ সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হবে।

৬. বাঙ্গালি সংস্কৃতির পরিপূর্ণ বিকাশ ও চর্চার পথ সুগম করতে হবে। যুবনীতিতে বর্ণিত যুবাদের আত্মত্যাগের ইতিহাসকে, সংবিধান, নাগরিক দায়িত্ব, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা যেগুলো শান্তির শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত তার চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।

৭.শহর ও গ্রামের যুবদেরমধ্যে সুযোগের যে বৈষম্য রয়েছে তা দূর করতে হবে। জাতীয় যুবনীতি ২০১৭ এর ১০ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত সামাজিক নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে শহর ও গ্রামের যুবদের মধ্যে আর্থ-সামাজিক ব্যবধান কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

৮. যুবসমাজে রূপান্তরের গতি প্রকৃতি, নতুন চাহিদা এবং প্রাপ্তির মাঝে বিদ্যমান শূন্যস্থানকে যৌক্তিক উপস্থাপনার মধ্যে নিয়ে তরুণদের শান্তিপূর্ণ মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

৯.যুবাদের বিচ্ছিন্নতাবোধকে দূর করার জন্য বিচ্ছিন্নতাবোধের কারণগুলোকে বের করতে হবে এবং সেগুলোকে দূর করতে হবে। পরিবেশ,সমাজ, রাষ্ট্র, ইতিহাস ও কলাণের রাজনীতি হতে বিচ্ছিন্নতাবোধের অনুভুতিকে দূর করার লক্ষ্যে জাতীয় যুবনীতি ২০১৭ এর ৯ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত যুবাদের হতাশা, বিষণ্ণতা ও অন্যান্য মানসিক / মনস্তাত্তিক সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে চিকিত্সা ও কাউন্সেলিং সেবার বিস্তৃতি ঘটাতে হবে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ।

১০. শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করাকে নীতিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও কার্যক্রম-নির্ভরতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। এসব ক্ষেত্রের এজেন্ডায় শাস্তির বিষয়টি নিয়ে আসতে হবে।

শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সঠিক নীতি প্রণয়ন কর্মসূচী গ্রহণ ও সহায়ক প্রতিষ্ঠানের জন্য বিবেচ্য বিষয়সমূহঃ

  • যুব সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি
  • যুবসমাজের মধ্যে বৈচিত্র্য ও অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব ও মূল্য দেয়া
  • শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুবদের মালিকানা, নেতৃত্ব ও জবাবদিহিতার ব্যাপারে সক্ষম করে তোলা
  • ‘ক্ষতি না করা নীতি অনুসরণ
  • সব পর্যায়ে শাস্তি প্রতিষ্ঠা ও সংঘাতোত্তর কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা
  • শাস্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যুবাদের শান্তি প্রতিষ্ঠায়ান, আচরণ, দক্ষতা ও যোগ্যতা বৃদ্ধি
  • যুবাদের মধ্যে আন্তঃপ্রজম্ম অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি
  • যুবাদের বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ ও বক্তব্য শোনার মানসিকতা
  • শান্তি প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত জ্ঞান ও দক্ষতার প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার ব্যবস্থা
  • রাষ্ট্র ও যুবসমাজের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং
  • যেসব যুব সদস্য সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে তাদের প্রতি সহায়তা আরো বৃদ্ধি

 

উপসংহার:

আন্তর্জাতিক যুৰদিবস ২০১৭ এর মূল শিক্ষা হচ্ছে যুবসমাজের জন্য এবং যুবসমাজের মাধ্যমে সংঘাতমুক্ত শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা। জাতীয়, আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে যুবসমাজকে ব্যাপকভাবে ক্ষমতায়িত করতে হবে। সার্বিকভাবে মহাত্মা গান্ধির বক্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

গান্ধির মতে সাতটি সামাজিক পাপকার্য শান্তিপূর্ণ, অহিংস ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের মূল অন্তরায়, এগুলো হলো চরিত্রহীন শিক্ষা, মানবতাবর্জিত বিজ্ঞান, নৈতিকতাহীন বাণিজ্য, বিনাশ্রমে অর্জিত সম্পদ, রাজনীতিতে নীতির অনুপস্থিতি, বিবেকবর্জিত আনন্দ এবং ত্যাগহীন অৰ্চনা। গান্ধির মতে অহিংসবাদ দুর্বলের জন্য নয়, সবলের শক্তি। এই শক্তি যুবরাই ধারণ করতে পারে, কেননা গান্ধি বলেছেন তরুণরা অন্যের হিংসার শিকার হয়েও কখনও প্রতিদানে হিংসাত্মক আচরণ করবে না, যা দুর্বল চিত্তের অনুসার মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় এবং সেখান থেকেই আক্রমণকারী অহিংসার শিক্ষা পাবে, শান্তির শিক্ষা পাবে।

 

ড. দেলোয়ার হোসেন

অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।