বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ। দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং সামাজিক জীবনধারার সঙ্গে কৃষি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। তাই কৃষি শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করা, প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা এবং কৃষিকে পেশাগত সম্ভাবনার একটি শক্তিশালী খাতে রূপান্তরিত করাই সময়ের দাবি। এই চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (BTEB) ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচার প্রোগ্রাম চালু করেছে, যা কৃষি শিক্ষাকে আরও বাস্তবমুখী ও কর্মমুখী করে তুলেছে।
ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচার
কোর্সের কাঠামো
ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচার একটি চার বছর মেয়াদি কারিগরি শিক্ষা প্রোগ্রাম। এতে মোট ৮টি সেমিস্টার বা পর্ব রয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখানে কৃষি বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর চাষাবাদ, পশুপালন, মৎস্যচাষ, কৃষি অর্থনীতি ও কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মতো বিষয়সমূহ শেখে।
প্রধান পাঠ্যবিষয়
- মৌলিক কৃষি বিজ্ঞান: মাটি, পানি, উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রাথমিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান।
- মাটি ও পানি ব্যবস্থাপনা: সেচ, সার প্রয়োগ, ফসল ব্যবস্থাপনা।
- ফসল উৎপাদন প্রযুক্তি: ধান, গম, ভুট্টা, সবজি, ফল ও নগদ ফসল উৎপাদনের আধুনিক পদ্ধতি।
- পশুপালন ও প্রাণি বিজ্ঞান: গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি ও অন্যান্য প্রাণির পরিচর্যা ও উৎপাদন বৃদ্ধি।
- মৎস্যচাষ প্রযুক্তি: মাছ উৎপাদন, পুকুর ব্যবস্থাপনা ও আধুনিক মাছ চাষ পদ্ধতি।
- কৃষি অর্থনীতি ও বিপণন: কৃষিপণ্য সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ ও কৃষি ব্যবসার কৌশল।
- কৃষি যন্ত্রপাতি ও কৃষি প্রকৌশল: আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, মেকানাইজড ফার্মিং, গ্রিনহাউস টেকনোলজি।
- তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃষি: কৃষিতে ICT-এর ব্যবহার, ডিজিটাল কৃষি, স্মার্ট এগ্রিকালচার।
ভর্তি যোগ্যতা
- এসএসসি (বিজ্ঞান/কৃষি/ভোকেশনাল) পাশ।
- ন্যূনতম জিপিএ ২.৫০ প্রাপ্ত হতে হয়।
- কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি বছর ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।
দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ
এই ডিপ্লোমা প্রোগ্রামে শিক্ষার্থীদের কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞান দেওয়া হয় না, বরং মাঠপর্যায়ের কাজের মাধ্যমে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাও প্রদান করা হয়।
- কৃষি খামারে হাতে-কলমে কাজ করা।
- গবেষণা মাঠে পরীক্ষামূলক চাষাবাদ।
- সরকারি কৃষি দপ্তর, এনজিও ও বেসরকারি কৃষি প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ।
- শিক্ষার্থীদের জন্য সফট স্কিল যেমন— নেতৃত্বগুণ, যোগাযোগ দক্ষতা ও কৃষি ব্যবসায়িক জ্ঞান উন্নয়ন।
কর্মসংস্থানের সুযোগ
ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচার পাস শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ বহুমুখী।
- সরকারি চাকরি: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, উপজেলা কৃষি অফিস ইত্যাদিতে কৃষি সহকারী কর্মকর্তা বা ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজের সুযোগ।
- বেসরকারি খাত: সার, বীজ, কীটনাশক কোম্পানি, কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও এগ্রো-ভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি।
- এনজিও খাত: ব্র্যাক, প্রাকৃতিক কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থায় কাজের সুযোগ।
- স্ব-উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ: কৃষি ফার্ম, গ্রীনহাউস, হাইড্রোপনিকস, জৈব সার উৎপাদন, ডেইরি ফার্ম ও পোল্ট্রি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করে সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা সম্ভব।
- বিদেশে কর্মসংস্থান: কৃষি দক্ষতা সম্পন্ন জনশক্তির চাহিদা রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
উচ্চশিক্ষার সুযোগ
ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচার শেষ করার পর শিক্ষার্থীরা দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটে বি.এসসি ইন এগ্রিকালচার, বি.এসসি ইন এগ্রি ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়।
বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে গুরুত্ব
বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচার শিক্ষার্থীরা—
- উৎপাদনশীলতা বাড়াতে নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগ করে।
- টেকসই কৃষি নিশ্চিত করে, যাতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা হয়।
- কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়, ফলে কৃষি ব্যবসা আরও লাভজনক হয়।
- ডিজিটাল কৃষি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে, যা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক।

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচার শুধু একটি ডিগ্রি নয়; এটি দেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে আরও আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও টেকসই করার একটি রূপরেখা। এর মাধ্যমে তৈরি হবে একদল দক্ষ, কর্মঠ ও সৃজনশীল কৃষিবিদ, যারা শুধু কৃষিক্ষেত্রে নয়, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।