২১শ শতাব্দী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগ। আজকের বিশ্বে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ছাড়া অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি কিংবা শিল্পখাতের কোনো অগ্রগতি কল্পনা করা যায় না। টেলিকমিউনিকেশন প্রযুক্তি এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তি। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (BTEB) তাই সময়োপযোগী দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন টেলিকমিউনিকেশন প্রযুক্তি কোর্স প্রবর্তন করেছে।
এই কোর্সের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আধুনিক টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম, মোবাইল নেটওয়ার্ক, ফাইবার-অপটিক প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন, ডাটা নেটওয়ার্কিং, ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) এবং নেক্সট জেনারেশন নেটওয়ার্ক (NGN) বিষয়ে হাতে-কলমে জ্ঞান অর্জন করে।
ডিপ্লোমা ইন টেলিকমিউনিকেশন
কোর্স কাঠামো ও মেয়াদ
ডিপ্লোমা ইন টেলিকমিউনিকেশন প্রযুক্তি একটি চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রাম। কোর্সটি মোট আটটি সেমিস্টারে বিভক্ত।
- প্রতি সেমিস্টারের মেয়াদ: ৬ মাস
- ক্লাসরুম শিক্ষাদান, ল্যাব প্র্যাকটিক্যাল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্ট এবং প্রজেক্ট ওয়ার্ক এর সমন্বয়
পড়ানো হয় যেসব বিষয়
টেলিকমিউনিকেশন প্রযুক্তি কোর্সে শিক্ষার্থীরা ধাপে ধাপে মৌলিক থেকে উন্নত স্তরের জ্ঞান লাভ করে। প্রধান বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
১ম ও ২য় সেমিস্টার (Foundation Courses)
- ইংরেজি, বাংলা ও গণিত
- পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন
- বেসিক ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
- কম্পিউটার ফান্ডামেন্টালস
- বেসিক ইলেকট্রনিক্স
৩য় ও ৪র্থ সেমিস্টার (Core Telecommunication Courses)
- টেলিকমিউনিকেশন ফান্ডামেন্টালস
- ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্স
- ইলেকট্রিক সার্কিট থিওরি
- নেটওয়ার্কিং ফান্ডামেন্টালস
- ট্রান্সমিশন সিস্টেমস
৫ম ও ৬ষ্ঠ সেমিস্টার (Advanced & Applied Courses)
- মোবাইল ও ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন
- ফাইবার অপটিক কমিউনিকেশন
- স্যাটেলাইট ও মাইক্রোওয়েভ কমিউনিকেশন
- ডাটা কমিউনিকেশন ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক
- সিগন্যাল প্রসেসিং
৭ম সেমিস্টার
- ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT)
- নেটওয়ার্ক সিকিউরিটি
- টেলিকমিউনিকেশন প্রজেক্ট
- ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট
৮ম সেমিস্টার
- ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্ট (৩–৪ মাস)
- চূড়ান্ত প্রজেক্ট ও রিপোর্ট সাবমিশন
ল্যাব ও ব্যবহারিক শিক্ষা
টেলিকমিউনিকেশন প্রযুক্তি শুধু বইপড়ার বিষয় নয়। এখানে ব্যবহারিক জ্ঞান সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের জন্য ল্যাবরেটরিতে যেসব হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়:
- ফাইবার-অপটিক কেবল জোড়া লাগানো ও নেটওয়ার্ক ডিজাইন
- মোবাইল নেটওয়ার্ক (2G/3G/4G/5G) কনফিগারেশন
- সিস্কো নেটওয়ার্কিং ও রাউটার সুইচ কনফিগারেশন
- অ্যান্টেনা ও মাইক্রোওয়েভ লিঙ্ক টেস্টিং
- স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন ডেমোনেস্ট্রেশন
কর্মক্ষেত্র ও ক্যারিয়ার সুযোগ
ডিপ্লোমা ইন টেলিকমিউনিকেশন প্রযুক্তি সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য দেশ-বিদেশে বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র রয়েছে।
বাংলাদেশে:
- মোবাইল অপারেটর কোম্পানি (গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক, টেলিটক)
- ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (ISP)
- বিটিসিএল, বেসরকারি টেলিকম কোম্পানি
- টেলিকমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট ডিস্ট্রিবিউটর
- সরকারি ও বেসরকারি প্রকৌশল দপ্তর
বিদেশে:
- মধ্যপ্রাচ্যের টেলিকম সেক্টর
- ইউরোপ ও আমেরিকায় নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান
- আন্তর্জাতিক স্যাটেলাইট ও কেবল কোম্পানি
উচ্চশিক্ষার সুযোগ
ডিপ্লোমা ইন টেলিকমিউনিকেশন প্রযুক্তি শেষ করার পর শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি ইন টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (EEE), কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (CSE) প্রভৃতি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারে।
কেন এই কোর্স গুরুত্বপূর্ণ?
- বাংলাদেশে টেলিকম সেক্টর বছরে প্রায় ১৫–২০% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- মোবাইল ফোন সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ১৯ কোটিরও বেশি, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রায় ১৩ কোটি (২০২৩ তথ্য অনুযায়ী)।
- তাই এই খাতে দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
- টেলিকমিউনিকেশন এখন শুধু যোগাযোগ নয়, বরং ই-কমার্স, ফিনটেক, হেলথ-টেক, এড-টেক সহ সব খাতের জন্য অপরিহার্য।

ডিপ্লোমা ইন টেলিকমিউনিকেশন প্রযুক্তি হলো এমন একটি শিক্ষা কর্মসূচি যা শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও কর্মক্ষেত্রের প্রস্তুতি—তিনটি দিকেই সমানভাবে শক্তিশালী করে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এ কোর্স করে শিক্ষার্থীরা শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও সম্মানজনক চাকরির সুযোগ পাচ্ছে।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিকম খাতের অগ্রযাত্রায় দক্ষ টেলিকমিউনিকেশন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা হবে আগামী দিনের পথপ্রদর্শক।