বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যেখানে মোট জাতীয় আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসে কৃষি ও পশুপালন খাত থেকে। কৃষির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, ছাগল, ভেড়া ও অন্যান্য প্রাণীর সঠিক ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যসেবা এবং উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষিত জনশক্তির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এ প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (BTEB) চালু করেছে ডিপ্লোমা ইন লাইভস্টক কোর্স।
এই কোর্সের মূল উদ্দেশ্য হলো— তরুণ-তরুণীদেরকে আধুনিক পশুপালন প্রযুক্তি, প্রাণী চিকিৎসা, খাদ্যব্যবস্থাপনা এবং প্রাণীসম্পদ খাতের উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।
ডিপ্লোমা ইন লাইভস্টক
কোর্সের কাঠামো
ডিপ্লোমা ইন লাইভস্টক একটি চার বছর মেয়াদি কারিগরি শিক্ষা প্রোগ্রাম। এটি বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত এবং সারা দেশের বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চালু রয়েছে।
ভর্তি যোগ্যতা
- এসএসসি (বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা বা মানবিক) পাস
- ন্যূনতম GPA শর্ত (প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্ন হতে পারে)
কোর্সের প্রধান বিষয়সমূহ
১. অ্যানিমেল সায়েন্স ও অ্যানাটমি – প্রাণীর শারীরবৃত্তীয় গঠন ও কার্যপ্রণালী
২. লাইভস্টক প্রোডাকশন – দুধ, মাংস, ডিম ও অন্যান্য প্রাণিজ খাদ্য উৎপাদন
৩. অ্যানিমেল নিউট্রিশন – প্রাণীর খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান
৪. ভেটেরিনারি মেডিসিন ও বায়োলজি – সাধারণ প্রাণীর রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
৫. ডেইরি ও পোল্ট্রি ম্যানেজমেন্ট – দুধ ও হাঁস-মুরগি খামারের আধুনিক ব্যবস্থাপনা
৬. লাইভস্টক ফিড টেকনোলজি – খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ
৭. প্রজনন ও কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তি (Artificial Insemination)
৮. ফার্ম ম্যানেজমেন্ট ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন
৯. কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি – আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনায় আইসিটির প্রয়োগ
১০. ইন্টার্নশিপ/প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং – সরকারি ও বেসরকারি খামার, ভেটেরিনারি ক্লিনিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে বাস্তব প্রশিক্ষণ
দক্ষতা উন্নয়ন
এই কোর্সে শিক্ষার্থীরা যেসব দক্ষতা অর্জন করতে পারে—
- গবাদিপশুর রোগ নির্ণয় ও প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান
- প্রাণীর খাদ্য ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনা
- আধুনিক খামার স্থাপন, পরিকল্পনা ও পরিচালনা
- দুধ, ডিম ও মাংস উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি
- পশু প্রজনন ও প্রজনন প্রযুক্তির ব্যবহার
- বায়ো-সিকিউরিটি ও স্বাস্থ্যসুরক্ষা ব্যবস্থা
- লাইভস্টক ভিত্তিক উদ্যোক্তা ও ব্যবসা পরিচালনার দক্ষতা
কর্মসংস্থান ও ক্যারিয়ার সুযোগ
ডিপ্লোমা ইন লাইভস্টক সম্পন্ন করার পর শিক্ষার্থীদের জন্য নানা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। যেমন—
সরকারি খাতে
- প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (DLS)-এ টেকনিশিয়ান, ভেট টেক অফিসার
- সরকারি পশু হাসপাতাল ও কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র
বেসরকারি খাতে
- পোল্ট্রি ও ডেইরি ফার্মে ম্যানেজার/সুপারভাইজার
- লাইভস্টক ফিড কোম্পানিতে টেকনিক্যাল অফিসার
- ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে টেকনিক্যাল সাপোর্ট অফিসার
- এনজিওর প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মকর্তা
স্ব–উদ্যোক্তা হিসেবে
- নিজস্ব গরু/ছাগল/পোল্ট্রি ফার্ম স্থাপন
- দুধ ও মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প
- ভেটেরিনারি ড্রাগ/লাইভস্টক ফিড ডিস্ট্রিবিউশন
বাংলাদেশের সম্ভাবনা
বাংলাদেশে প্রতিবছর গরু–ছাগলের মাংস, দুধ ও ডিমের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি দেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য দেশে হালাল মাংস রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দক্ষ ডিপ্লোমা ইন লাইভস্টক পেশাজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন।
জাতীয় উন্নয়নে অবদান
- দুধ ও মাংসে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন
- গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি
- কৃষির পাশাপাশি অ্যাগ্রো–বেসড ইন্ডাস্ট্রি সম্প্রসারণ
- বিদেশে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি
চ্যালেঞ্জ
তবে কোর্সটি বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে—
- পর্যাপ্ত আধুনিক ল্যাব ও গবেষণা সুবিধার অভাব
- ফিল্ড-ভিত্তিক প্রশিক্ষণের সীমাবদ্ধতা
- গ্রামীণ খামারগুলোতে প্রযুক্তি প্রয়োগে সচেতনতার ঘাটতি
- ডিপ্লোমা পাস শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি চাকরির সীমিত সুযোগ

ডিপ্লোমা ইন লাইভস্টক বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রাণিসম্পদ খাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা কর্মসূচি। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের উদ্যোগে পরিচালিত এ কোর্স কেবল শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের সুযোগই বাড়াবে না, বরং বাংলাদেশকে দুধ, মাংস ও ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলতে অবদান রাখবে। সঠিক বিনিয়োগ, আধুনিক ল্যাব স্থাপন এবং নীতি সহায়তা নিশ্চিত করা গেলে এ খাতটি বাংলাদেশকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নতুন দ্বারও উন্মোচন করে দিতে পারবে।