বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত দ্রুত বিকাশমান হলেও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি দীর্ঘদিন ধরেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চিকিৎসক ও নার্সদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক মিড–লেভেল হেলথ টেকনোলজিস্ট, প্যারা–মেডিকেল কর্মী ও স্বাস্থ্যসেবা সহায়ক পেশাজীবী প্রয়োজন হয়। এই ঘাটতি পূরণের জন্য বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (BTEB) তাদের নিয়মিত কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে Diploma in Health Technology & Services চালু করেছে। এর লক্ষ্য হলো দক্ষ, আধুনিক প্রযুক্তি-ভিত্তিক স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে গতিশীল করা।
ডিপ্লোমা ইন হেলথ টেকনোলজি এন্ড সার্ভিসেস
প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস
বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং, ভোকেশনাল ও কারিগরি শিক্ষা কোর্স পরিচালনা করে আসছে। স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বোর্ডের কারিকুলামে Health Technology & Services অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
- এর মূল লক্ষ্য হলো স্বাস্থ্য খাতে প্রযুক্তি নির্ভর ডিপ্লোমা পেশাজীবী তৈরি করা, যারা হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, গবেষণাগার, ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি এবং ফিল্ড লেভেলের স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করতে সক্ষম হবে।
- ২০১৫ সালের পর থেকে BTEB ক্রমান্বয়ে এই প্রোগ্রামের পাঠ্যক্রম উন্নয়ন করেছে এবং দেশের বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি ইনস্টিটিউটে এ কোর্স চালু হয়েছে।
কোর্স কাঠামো ও মেয়াদ
ডিপ্লোমা ইন হেলথ টেকনোলজি এন্ড সার্ভিসেস সাধারণত ৪ বছর মেয়াদি (৮ সেমিস্টার) প্রোগ্রাম, যা SSC পাশ শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারে।
প্রধান পাঠ্যক্রম
পাঠ্যক্রমে সাধারণ শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও বিশেষায়িত বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকে। এর মধ্যে রয়েছে—
- মৌলিক বিজ্ঞান
- অ্যানাটমি ও ফিজিওলজি
- বায়োকেমিস্ট্রি
- মাইক্রোবায়োলজি
- ফার্মাকোলজি
- স্বাস্থ্য প্রযুক্তি সম্পর্কিত বিষয়
- ল্যাবরেটরি টেকনোলজি
- রেডিওলজি ও ইমেজিং
- ফিজিওথেরাপি
- ডেন্টাল টেকনোলজি
- এনভায়রনমেন্টাল হেলথ
- কমিউনিটি হেলথ সার্ভিস
- প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ
- হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ
- ডায়াগনস্টিক সেন্টারে হাতে-কলমে কাজ
- ফিল্ড লেভেল হেলথ সার্ভিস সাপোর্ট
- সহায়ক কোর্স
- ইংরেজি ও যোগাযোগ দক্ষতা
- কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন
- মেডিকেল এথিকস
- পাবলিক হেলথ ও হেলথ পলিসি
কর্মসংস্থানের সুযোগ
এই কোর্স সম্পন্নকারী শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ পান:
- সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল – টেকনোলজিস্ট, ল্যাব টেকনিশিয়ান, রেডিওলজি অপারেটর ইত্যাদি।
- ডায়াগনস্টিক সেন্টার – ল্যাব রিপোর্ট, এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, ইসিজি পরিচালনা।
- কমিউনিটি হেলথ প্রোগ্রাম – এনজিও বা সরকারি স্বাস্থ্য প্রকল্পে কাজ।
- ফার্মাসিউটিক্যাল ও মেডিকেল ইকুইপমেন্ট কোম্পানি – টেকনিক্যাল সাপোর্ট ও সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে।
- বিদেশে কর্মসংস্থান – মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্য খাতে বিপুল চাহিদা।
জাতীয় উন্নয়নে ভূমিকা
বাংলাদেশে প্রতি বছর স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। চিকিৎসক-রোগী অনুপাত এখনো বৈশ্বিক মানদণ্ডের নিচে। এ পরিস্থিতিতে হেলথ টেকনোলজি ও সার্ভিস ডিপ্লোমাধারীরা—
- চিকিৎসকদের সহায়ক হিসেবে কাজ করে চিকিৎসা সেবা সহজতর করছে।
- ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেবার মান উন্নত করছে।
- কমিউনিটি লেভেলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছে।
- মেডিকেল ট্যুরিজম ও আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার পথে অবদান রাখছে।
চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
যদিও এই কোর্সটির সম্ভাবনা অনেক, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে—
- প্রতিষ্ঠান ও ল্যাবের অভাব – সব ইনস্টিটিউটে পর্যাপ্ত ল্যাব সুবিধা নেই।
- শিক্ষক সংকট – দক্ষ শিক্ষক ও প্রশিক্ষক সংখ্যা সীমিত।
- চাকরির স্বীকৃতি – সরকারি চাকরিতে স্পষ্ট পদমর্যাদা ও সুযোগের অভাব।
- জনসচেতনতার অভাব – অনেকেই এই ডিপ্লোমার গুরুত্ব বুঝতে পারে না।
করণীয়
- সরকারি পর্যায়ে পদ সৃষ্টি ও স্বীকৃতি প্রদান।
- আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে কারিকুলাম হালনাগাদ।
- শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন।
- বিদেশি চাকরির বাজারে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা তৈরি।
বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ডিপ্লোমা ইন হেলথ টেকনোলজি এন্ড সার্ভিসেস কেবল একটি শিক্ষাকোর্স নয়, বরং দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতকে দক্ষ জনশক্তি দিয়ে শক্তিশালী করার একটি বড় পদক্ষেপ। এ কোর্সের সঠিক বাস্তবায়ন হলে দেশের ভেতরে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মান উন্নত হবে এবং একইসাথে বিদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।
স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন ও “সবার জন্য স্বাস্থ্য” লক্ষ্য অর্জনে এ ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম আগামী দিনের বাংলাদেশকে আরও সুস্থ, কর্মক্ষম ও আধুনিক করে তুলবে।