পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা

পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা – সজীব কুমার বণিক  ও খালেদা চৌধুরী ।

The aim of this paper is to explore the interrelationship between the East Pakistan riot of 1964 and the growth of Bengali nationalism. The 1964 East Pakistan riot refers to the massacre of Bengali Hindus and some of the cases Bengali Muslims by the Pakistani Bihari in the wake of and alleged theft of what was believed to be the profhet’s hair from the Hazratbal shrine in Jammu and Kashmir.

But the main effect of this riot is the growth of Bengali nationalism which led the East Pakistan to the liberation war of 1971. The language movement of 1952 of the then East Bengal can be depicted as the rising period of language based on Bengali nationalism against the Muslim religion based Pakistani nationalism.

This Bengali nationalism had been flourished by the mass uprising of Bengali people against the Pakistani Bihari massacre and ethnic cleansing of Bengali Hindus in 1964.

Progressive minded Bengali Political leaders, Journalists, Cultural Activists such as Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Ataur Rahman Khan, Tofazzal Hossain, Abdus Samad, Sufia Kamal and so on stood against the Bihari rioters. Students and general people of East Pakistan did the same. This all created a sense of Bengali nationalism, on the basis of this nationalism Bangladesh becomes independent in 1971.

পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা

বাংলাদেশ পৃথিবীতে সম্ভবতঃ একমাত্র দেশ যা দু’বার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। ১৯৪৭ সালে প্রথম ব্রিটিশ ভারত থেকে স্বাধীনতার পর যে অবিভক্ত পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল তাকে পুনরায় বিভক্ত করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ভাগ্য বিপর্যয়ের পর বাংলা প্রায় দুই শতাব্দীব্যাপী ব্রিটিশ পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ হয়।

এই দুইশত বছরের ব্রিটিশপনিবেশিকঔ শাসনের অধীনে বাংলা কেবল অর্থনৈতিকভাবে শোষিত বা নিপীড়িত হয়েছে তাই নয় ব্রিটিশরা তাদের ভাগ কর ও শাসন কর নামক কূটনীতির দ্বারা বাংলার আবহমান কাল ধরে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সেদ্ধহার্দ্যকে বিনষ্ট করে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন এলিট শ্রেণিপূর্বতন ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানকে একটি উপনিবেশ হিসেবে বিবেচনা করে শাসন পরিচালনা করে। আর এখানে যাতে বাঙালিদের মধ্যে কখনো জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটতে না পারে এবং দীর্ঘদিন এ অঞ্চলকে যাতে শাসন ও শোষণ করা যায় সেজন্য বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক ঐক্য বিনষ্ট করার লক্ষ্যে নানাভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা ঘটায়।

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

মূলত ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি তথা পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিভিন্ন সময় -দাহাঙ্গামা সংঘটিত হতে থাকে। এর মধ্যে ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারেরউস্কানিতে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয় বলে ধারণা করা হয়।

১/ আরও মনে করা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আইয়ুব খান অত্যন্ত কেদ্ধশলী পন্থায় প্রদেশের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করার লক্ষ্যে গভর্ণর মোনায়েম খানের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানেই ঘটেছিল।

২/ প্রকৃতপক্ষে ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয় তা দাঙ্গার ব্যাপকতা ও প্রসারতার কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ দাঙ্গা প্রথমে হিন্দু-মুসলমান, পরে বাঙালি-বিহারিতে রুপান্তরিত হয়।৩ এ দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দু সাম্প্রদায় যাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এসময় পার্শ্ববর্তী ভারতেদেশ শরণার্থী হিসেবে চলে যেতে বাধ্য হয় এবং ১৯৬৪ সালের পর হিন্দুদের দেশত্যাগ অব্যাহত থাকে।

১৯৬৪ সালে যে ঘটনার পরিপে‘ক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত হয় তার উৎস পূর্ব পাকিস্তান নয় বরং ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীর। তৎকালীন করাচি হতে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক‘“DAWN”’ পত্রিকাতে ১৯৬৪ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদনে দাঙ্গার উৎস সম্পর্কে কিছুটা তথ্য পাওয়া যায়।

প্রথম দাঙ্গার সূত্রপাত হয় ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের অন্তর্গত হজরতবাল মসজিদে সংরক্ষিত হযরত মুহাম্মদ (স.) এর পবিত্র কেশ অপহরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এ ঘটনার পরিপে‘ক্ষিতে ভারতে বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার কলকাতার পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানেও সরকারি মদদে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত হয়।

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

‘ “DAWN”’ পত্রিকাতে প্রকাশিত সংবাদ হতে জানা যায় যে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতানুযায়ী ১৯৬৩ সালের-২৭২৬ ডিসেম্বর রাতে হজরতবাল সজিদম হতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর পবিত্র কেশ চুরি হয়। কিন্তু‘“DAWN”’ পত্রিকার ভাষ্য মতে, এ চুল চুরি হয় পূর্ববর্তী -রাত্রি৫টার৩মধ্যে। ২৬-২৭ ডিসেম্বর রাতে চুরি হওয়া অসম্ভব কেননা সেদিন বৃহস্পতিবার রাত হওয়ায় অসংখ্য ভক্তরা সজিদম প্রাঙ্গনে সমবেত ছিল। কিন্তু এটি পূর্ববর্তী রাতে চুরি করা খুবই সহজ।

প্রত্যক্ষদর্শী এক গোয়ালার সাক্ষ্য ঐ রাতে অনুযায়ী ৭ জন দুর্বৃত্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়িতে মসজিদে আসে এবং মহানবীর চুল অপসারনের পর তারা গাড়িতে করে পালিয়ে যায়। দুর্বৃত্তদের মধ্যে কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্সের সাধারন সম্পাদক বখশী আব্দুর রশীদ উপস্থিত ছিল। যখন এই পবিত্র স্মৃতি চুরি হবার সংবাদ বাইরে ছড়িয়ে পড়ে তখন হাজার হাজার মুসলমান এ ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে।

২৮ ডিসেম্বর কাশ্মীরে প্রায় ২ লক্ষ জনতা হাতে কালো ও সবুজ রংয়ের পতাকা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা যখন লাল চকের [ Lal Chowk ] দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন নিরাপত্তা বাহিনী তাদের বাধা ধেয় এবং গুলিবর্ষণ করে। ফলে মুহূর্তেরমধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

এ পর্যায়ে কাশ্মীরের স্টেট কংগ্রেস এর সভাপতি শফি কোরেশী, পলিটিক্যাল কনফারেন্স এর সভাপতি গোলাম মহিউদ্দিন কারা এবং গণভোট ফ্রন্টের মোজাহিদ ঘটনাস্থলে পেদ্ধঁছে বিক্ষোভকারীদের শান্ততে হও জামিয়া মসজিদে চলে যেতে রাজি করাতে সক্ষম হয়। এসময় হঠাৎ করেই ন্যাশনাল কনফারেন্স এর সেক্রেটারী বখশী আব্দুর রশীদ ও শ্রীনগর ন্যাশনাল কনফারেন্স এর সভাপতি আম্মা সূফী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন।

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

এসময় বখশী আব্দুর রশীদ চিৎকার করে জনতার উদ্দেশ্য বলেন যে, ’তোমরা চিৎকার চেঁচামেচি কেন করছো? তোমাদের বাড়িতে কি খাবারের অভাব পড়েছে। চলে যাও। এটা তোমাদের চিন্তার বিষয় না। খুঁজে বের করা আমাদের দায়িত্ব। যেভাবে এটা অদৃশ্য হয়ে গেছে সেভাবেই এটার পুনরাবির্র্ভাব ঘটবে। “বখশী রশীদের এই উদ্ধত আচরণ জনতাকে আরও বিক্ষুব্ধ করে তুলে ও তারা রশীদকে ধাওয়া করার পাশাপাশি ধ্বংসাত্বক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়।

এসময় আরেকটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, আব্দুর রশীদ পালিয়ে কোথি বাগ(Kothi Bagh) পুলিশ স্টেশনে লুকিয়ে আছে। এসময় জনতা পুলিশ স্টেশন ঘেরাও করলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে এবং এতে ৩ জন নিহত ও প্রায় ৩০০ জন আহত হয়। এ ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দলীয় নেতাদেরফতারগ্রেকরে।

ফলে শ্রীনগর ও অন্যান্য শহরে ব্যাপক বিক্ষোভের সূচনা হয়।৪ এদিকে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি কাশ্মীরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শামসুদ্দীন ঘোষণা করেন যে, হজরতবাল হতে অপহৃত রসুলুল্লাহর পবিত্র কেশ উদ্ধার করা গিয়েছে।৫

কিন্তু তা সত্বেও জনরোষ সম্পূর্ণ প্রশমিত হয়নি এবং অনেকে এ তথ্যের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।৬

ভারতের শ্রীনগরে অবস্থিত হজরতবাল মসজিদ থেকে মুহম্মদের পবিত্র স্মৃতি অপহরণে বিষয় নিয়ে যখন জম্মু ও কাশ্মীরে ব্যাপক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ চলমান তখন পূর্ব পাকিস্তানেও এর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এসময় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামিক বোর্ডের উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য আব্দুল হাই পূর্ব পাকিস্তানে ওহিন্দুঅ-মুসলিমদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন।৭

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

এমনকি পাকিস্তানের তৎকালীন পে‘সিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকা থেকে ইসলামাবাদ প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন যে, হজরতবালের ঘটনা নিয়ে পাকিস্তানে কোনও প্রতিক্রিয়া হলে তিনি এর কোনও দায়ভার গ্রহণ করতে পারবেন না।৮

হজরতবাল ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রথমে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা যায়। প্রদেশের বিভিন্ন স্থান হতে কয়েকজন পরিষদ সদস্য ১ জানুয়ারি গভীর ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেন। এছাড়া এদিন করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন ও শহরের বিভিন্ন কলেজের ছাত্র সংসদের ৩০ জন এক বিবৃতিতে হজরতবালের ঘটনার গভীর উদ্বেগ ও দুঃখ প্রকাশ করেন।৯

এদিকে পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগ ১৯৬৪ সালের ৩ জানুয়ারি ”কাশ্মীর দিবস্র ঘোষণা করে।১০এর পরিপে‘ক্ষিতে ৩ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের খুলনা ও দৌলতপুরে দুর্বৃত্তরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা ঘটায় তারা বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু সাম্প্রদায়ের গৃহ ও দোকানপাটে লুটতরাজ ও ক্ষেত্রবিশেষে অগ্নিসংযোগ করে। তবে দাঙ্গা সৃষ্টি করে শহরের শান্তি বিনষ্ট করতে গেলে কিছু সংখ্যক সমাজের সুস্থ চেতনাসম্পন্ন নাগরিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় ও বিপন্ন নাগরিকদের আশ‘য় দেয়।

অবস্থার গুরুত্ব বিবেচনা করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা ৬টা হতে ভোর পর্যন্ত খুলনা শহরে ও দৌলতপুরে সান্ধ্য আইন ও অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। সন্ধ্যা হতে ই.পি.আর (ঊ.চ.জ) বাহিনীকে মোতায়েন করা হলে রাত্রি সাড়ে ৮টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেআসে।১১

৩ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানরেরসরকাএক পে‘সনোটে বলা হয় খুলনার দৌলতপুর এলাকায় প্রায় ২০ হাজার মিল শ‘মিক এদিন মিছিল বের করে ও এক পর্যায়ে তারা উগ্র হয়ে বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দুদের গৃহের ক্ষতিসাধন ও দোকানপাট লুটতরাজ করে। পুলিশ ও ই.পি.আর তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেবার কিছুক্ষণ পর আর একদল মিল শ‘মিক দৌলতপুরের নিকটবর্তী আরেকটি গ্রাম আক্রমণ করে তারা ড়িবা-ঘর লুট ও অগ্নিসংযোগ করে।১২ পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলেয় এবংযা প্রায় ৭৩ জন দাঙ্গাকারীকে গ্রেফতার করে।

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

এদিকে ৫ জানুয়ারি খুলনার কোনওকোনও অঞ্চলে প্রায় ৪০% দোকানপাট বন্ধ থাকে। গত দ্রুদিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায় ২৩৬ জনকে গ্রেফতারকরা হয়। খুলনা শহরের অবস্থা ক্রমশ এসময় স্বাভাবিক হয়ে আসলেও দাঙ্গাকারীরা দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

৫ জানুয়ারি রাতে খুলনার ৩৬ মাইল দূরবর্তী মংলা বন্দর এলাকায় গ্রামাঞ্চলে যথাক্রমে শ্যাওলাবুনিয়া, কানাইনগর এবং মোকাদ্দমপুরে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে কিছু কিছু লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া যায়। এসময় ১০ জন দাঙ্গাকারীকে গ্রেফতার ছাড়াও ১৪টি লাশ উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে বাগেরহাটের রুপসা হতে মুলঘর স্টেশনের পার্শ্ববর্তী নীলাপুর, সামন্তসেনা, খাজুরা, চুলকাঠি ও আলাইপুর গ্রামেওঘটিতদাঙ্গাহয়। সং১৩

পাকিস্তানি সরকার পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনকেভিন্নখাতে পরিচালিত করার লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে ৭ জানুয়ারি ঢাকা, আদমজী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় পেশাদার গুন্ডা দিয়ে হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-বিহারি দাঙ্গার সূচনা করে। ১০ জানুয়ারি তা তীব্র আকার ধারণ করে ও শত শত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ১৪হয়।

অবশ্য এসময় খুলনার দাঙ্গা পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়।১৫ ৯ জানুয়ারি বিকেলে কলকাতা এবং এর শহরতলী এলাকায় হঠাৎ করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হলে ১২ জন ছুরিকাহত হয়। চব্বিশ পরগণা জেলার সীমান্তবর্তী বনগাঁও শহর, বারাসাত ও হাওড়া এলাকায় দাঙ্গার তীব্রতা পরিলক্ষিত হয়।১৬

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

পরবর্তী দু’দিন কলকাতায় ব্যাপকভাবে দাঙ্গা চলতে থাকে। ১১ জানুয়ারিপর্যন্ত দাঙ্গায় পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৬০ জন ব্যক্তি নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয় বলে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মি. পি.সি সেন ঘোষণা করেন।১৭ এছাড়া ১১ জানুয়ারি অপরাহ্ণপর্যন্ত একমাত্র যশোর জেলাতেই পশ্চিমবঙ্গের দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকা হতে প্রায় ৩০ হাজার মুসলমান আগমন করে।

পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগণা জেলার বনগাঁও মহকুমা হতেই অধিকাংশ মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে আশ‘য় গ্রহণ করে।১৮১৩ জানুয়ারি বি.বি.সি(ই.ই.ঈ) নিউজের বরাতে জানা যায় যে, কলকাতা হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় প্রায় ১০০ জন নিহত ও ৪৩৮ জন আহত হয়েছে। এছাড়া ৭০০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

 

অন্যদিকে এর প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তান হিন্দু-বিরোধী দাঙ্গা শুরু হয় যাতে ২৯ জন নিহত হয়।১৯ মূলত কলকাতায় সংঘটিত দাঙ্গা পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ১০ জানুয়ারি পাবনায় হঠাৎ করেই উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। খুলনায় ১০ জানুয়ারি সান্ধ্য আইনের মেয়াদ অনির্দিষ্টকালের জন্য বৃদ্ধি করা ২০হয়।

এদিকে ১১ জানুয়ারি ঢাকার ৮ জন সাংবাদিক ও পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের দুইজন কর্মকর্তা এক যুক্ত বিবৃতি প্রদান করে যাতে খুলনার সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে গভীর দুঃখ প্রকাশ করা হয় এবং মানবতার দুশমনদের রুখে দাঁড়াবার আহবান জানানো হয়।*১ এছাড়া একই দিনে মওলানা ভাসানী মীর্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতাল একেেকবিবৃতিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণœও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রতি দৃষ্টি রাখার আহবান জানান।২১

কলকাতায় ১২ জানুয়ারি দাঙ্গা পরিস্থিতির অবনতি হলে ৩টি এলাকায় ২৪ ঘন্টাব্যাপী সান্ধ্য আইন জারি করার পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৫৯ দফা গুলিবর্ষণ করা ২২হয়।

*যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারিদের মধ্যে জনাব তফাজ্জলাসেন,হে সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক; আব্দুস সালাম,সম্পাদক, পাকিস্তান অবজারভার। এস.জি. এম বদরুদ্দীন আবাসিক সম্পাদক, মর্নিং নিউজ, ঢাকা; জহর

হোসেন চেদ্ধধুরী, সম্পাদক, সংবাদ; কে.জি. মোস্তফা, পে‘সিডেন্ট, পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন; সিরাজুল

হোসেন খান, জেনারেল সেক্রেটারী, পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন অন্যতম। (সূত্র:দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ জানুয়ারি ১৯৬৪)

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

১৩ জানুয়ারি হতে কলকাতার দাঙ্গা পরিস্থিতির অনেকটা শান্ত হয়ে আসে। কলকাতার দাঙ্গার সূত্র ধরে ঢাকায় গুজব ছড়িয়ে উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা চালানো হয়। এসময় ঢাকার ডেপুটি কমিশনার আবুল খায়ের ও সিটি এম.পি ইয়াহিয়া চেদ্ধধুরী অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ মোতায়েনরন।২৩

এদিকেকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ১৩ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে দেশের সকল শ্রেণির জনসাধারণ বিশেষ করেছাত্রসমাজকে সাম্প্রদায়িক শান্তি অক্ষুণœরাখার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে মানবতার দুশমনদের রুখে দাঁড়াবার আহবান জানান।

শেখ মুজিবুর রহমান তারবৃতিতেবি দেশবাসীকে সা§প্রদায়িক প্রতিশোধ ও পাল্টা প্রতিশোধের ঘৃণ্য চক্রের উর্ধ্বে থেকে মাথা ঠান্ডা রাখার আহবান জানান এবং একইসাথে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের সা§প্রদায়িক ঘটনাবলীতে উত্তেজিত না হবার আবেদন জানান।*২

শুধু বিবৃতি প্রদানই নয় শেখ মুজিবুর রহমান ১৪ জানুয়ারি দাঙ্গা প্রপিয়েতরাধে ঝাঁ পড়েন।২৪ এছাড়া ১৩ জানুয়ারি পাকিস্তানি লেখক সংঘের এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের পূর্ব পাকিস্তান কমিটি পাকিস্তানের জনসাধারণের কাছে সীমান্তের অপর পারের উত্তেজনা ও উস্কানি সত্বেও বিভিন্ন সাম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখার আহবান জানানো২৫ হয়।একই দিনে ঢাকার নেতৃস্থানীয় হলাগণমি এক যুক্ত বিবৃতিতে সম্প্রীতির দুশমনদের রুখে দিতে- মা বোনদের এগিয়ে আসার আহবান জানান। * *

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

এদিকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের অবস্থা বরাবর শান্ত থাকার পর ১৩ জানুয়ারি সোমবার শেষ রাতের দিকে নারায়ণগঞ্জের মিল এলাকায় ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামার সংবাদ পাওয়া যায় এবং এসময় নারায়ণগঞ্জের জেলেপাড়া ও গোদনাইলে বেশকিছু গৃহে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তবে ১৪ জানুয়ারি বিকেল ৪টার দিকে পরিস্থিতির মারাত্বক রুপ ধারণ করে।

এজন্য এদিন ৪টার পর হতে নারায়ণগঞ্জে ২০ ঘন্টার জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। ১৪ জানুয়ারি সারাদিন কিছুটা শান্ত থাকার পর সন্ধ্যার দিকে ঢাকার নওয়াবপুর রোডেকিছু দোকানে দাঙ্গাকারীরা অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে অগ্নিসংযোগ করা হয় বিধায় এদিন রাত ১০টা হতে পরদিন ভোর ৫টা পর্যন্ত ঢাকা শহরে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। ২৬।

ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিস্তার লাভ করলে ১৪ জানুয়ারি পূর্ব কিস্তানেরপা প্রগতিশীল শিক্ষক-ছাত্র শ‘মিকÑবুদ্ধিজীবী প্রভৃতি সকল মহল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন *শেখ মুজিবুর রহমান তার বিবৃতিতে বলেন, ’সাম্প্রদায়িকতাবাদপুনরায় দুঃস্বপ্নময় বিভীষিকা ও হিংসোন¤ত্ততার রুপ লইয়া আত্বপ্রকাশ করিয়াছে।

ইহার অন্ধভাবে ঘৃণা করার মারাত্বক দর্শন সর্বপ্রকার মানবিক মূল্যবোধকে তলাইয়া দিতেছে। ইহার কবলে ইতিমধ্যেই অসংখ্য নিরীহ মানুষ প্রাণ বিসর্জনরয়াছেকি এবং আরও হাজার হাজার লোক রাতারাতি সর্বস্বান্ত হইতে চলিয়াছে। আমি আমার দেশবাসীর কাছে সাম্প্রদায়িক প্রতিশোধ ও পাল্টা প্রতিশোধের ঘৃণ্য চক্রের উর্ধ্বে থাকার জন্য তাহাদের মাথা ঠান্ডা ও অন্তর পরিষ্কার রাখার জন্য এবং কলিকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অংশের দু:খজনক ঘটনাবলীতে উত্তেজিতনা হবার জন্য আবেদন জানাইতেছি“।

(তথ্যসূত্র: খন্দকার কামরুল হুদা,স্বাধীনতা সংগ্রাম ও শেখ মুজিব,ঢাকা: জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ১৯৯৫, পৃ. ৮৪)

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

**বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারিগণের মধ্যে বেগম সুফিয়া কামাল, রোকাইয়া আনোয়ার এম.এন.এ, রইসা হারুন, সামসুন নাহার রহমান, বদরুন্নেসা রহমান,জিয়ারা মতিন, নীলিমা ইব্রাহীম, নুরজাহান বেগম, ডক্টর নিলুফার ইসলাম অন্যতম। (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ জানুয়ারি ১৯৬৪)

দেশবাসীর নিকট দাঙ্গা প্রতিরোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণœরাখার আহবান জানান।

এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রসংস্থা এবং ঢাকার বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠানের ১৮ জন ছাত্রনেতা এক যুক্ত বিবৃতিতে দাঙ্গা প্রতিরোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আহবান জানান।২৭

এছাড়াও এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রখ্যাত অধ্যাপক, কবি এবং সাহিত্যিক এক যুক্ত বিবৃতিতে পাকিস্তানিদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে বিরত থাকার আহবান জানান।*৩

তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলামের পে‘সিডেন্ট মাওলানাদ সৈয়মুসলেহ উদ্দিন এবং প্রাদেশিক আঞ্জুমান মোহাজেরিনের সাধারণ সম্পাদক এস.কে ভূঁইয়া এক বিবৃতিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার উদাত্ত আহবান জানান।২৮ পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যবৃন্দ ছাত্রলীগের সকল শাখাকে সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্যজনমত গঠনের জন্য তৎপর হতে নির্দেশ দেয়।২৯

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

১৪ জানুয়ারি সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক পে‘স রিলিজে পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক স§ে¦লন কমিটি, ছায়ানট ও আঞ্জুমানে আদাব সকল লেখক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীর প্রতি সকল মহল্লা ও ওয়ার্ডে সমাজবিরোধী ব্যক্তিকে রুখিবার উদ্দেশ্য শান্তি স্কোয়াড ও অতন্দ্রদৃষ্টি রাখার জন্য কমিটি গঠনের আহবান জানানো হয়।৩০

এদিন বিকেলে আতাউর রহমান খানের বাসভবনে বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে শান্তি ও শৃংখলা বজায় রাখার জন্য সকল দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত৩১ হয়।এছাড়া সর্বদলীয় নেতৃসভা নিয়মিতভাবে শহরের দাঙ্গাকবলিত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।

জাতীয় ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ এবং শ‘মিক ও ছাত্র প্রতিনিধিগণ ১৪ জানুয়ারি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা সফর করেন এবং এসকল অঞ্চলের জনগণকে নিজ নিজ এলাকায় শান্তি ও শৃংখলা রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে বলেন। পরিদর্শকদেরমধ্যে আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চেদ্ধধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান, মাহমুদ আলী, অলি আহাদ এবং তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া অন্যতম।৩২

এদিকে ১৫ জানুয়ারি তারিখেও ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে দাঙ্গার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। ১৫ জানুয়ারি দাঙ্গাবিধ্বস্ত হিন্দু সাম্প্রদায়কে বাঁচাতে গিয়ে নবাবপুরসং রেলক্রএিরসামনে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হন কবি ও বিশিষ্ট নজরুল গবেষক আমির হোসেন চেদ্ধধুরী, তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক নজরুল ফোরামের চেয়ারম্যান।৩৩

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

তাছাড়া ১৫ জানুয়ারি মোহাম্মদপুরে অবস্থানরত ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের ছাত্রী হোস্টেলে বিহাররা হামলা চালিয়ে মেয়েদের শ্লীনতাহানি করে।৩৪ সমগ্র পরিস্থিতি এভাবে ভয়াবহ ও নিয়ন্ত্রণহীণ হয়ে পড়ে। ঢাকায় এদিন বিশেষ শ্রেণীর দুষ্কৃতিকারী তথা বিহারীরা দৈনিক ইত্তেফাক অফিসে হামলা চালায়। এছাড়া এদিন ঠাটারীবাজার, সদরঘাট, যাত্রাবাড়ি, নয়াপল্টন, গেন্ডারিয়া প্রভৃতি এলাকায় দুর্বৃত্তরা সংখ্যালঘু ও স্থানীয় মুসলমানদের দোকানপাট ও অগ্নিসংযোগগৃহে করে।৩৫

*বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামিক শিক্ষা বিভাগের অধ্যক্ষ ড. সিরাজুল হক, বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের ডাইরেক্টর ড. ইনামুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যক্ষ ড. এ. বি.এম. হাবিবুল্লাহ, ইংরেজি বিভাগের অধ্যক্ষ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, বাংলা একাডেমির পরিচালক আলী আহসান অন্যতম। (সূত্র:দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ জানুয়ারি ১৯৬৪)

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

১৫ জানুয়ারি সকাল ১১ টায় জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ ঢাকায় এক শান্তি অভিযান বের করে। এতে আতাউর রহমান খান, সৈয়দ আজিজুল হক, আব্দুস সামাদ, শাহ আজিজুর রহমান, মাহমুদ আলী, নুরুর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।

এ শান্তি অভিযান পুরান ঢাকারবিশেষ করে ইসলামপুর, আরমানীটোলা, ওয়ারী এলাকার হেয়ার স্ট্রীট, লারমিনি স্ট্রীট, ফোলডার স্ট্রীট প্রভৃতি রাস্তা পরিক্রমণ করেন।ণকালেপরিক্রমতিনটি স্থানে শান্তিদূতদের ওপর দুর্বৃত্তরা হামলা৩৬শেখকরে।মুজিবুর রহমান এদিন ওয়ারী এলাকায় সংখ্যালঘু অধিবাসীদের নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরেরায় চেষ্টব্যাপৃত থাকাকালে দুষ্কৃতিকারীদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হন।

কিন্তু তা সত্বেও তিনি প্রায় ৫০০ জন সংখ্যালঘু অধিবাসীকে স্থানান্তরে সক্ষম হন। এদিকে চট্টগ্রামেও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দিলে ১৫ জানুয়ারি ১৫ দিনের জন্য চট্টগ্রামের ৩টি থানায় যথাক্রমে কোতোয়ালী, ডাবলবুরিং এবং চলাইশপাঁ থানায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।৩৭ খুলনায় বিভিন্ন সংখ্যালঘুদের আশ‘য় দেওয়ার অপরাধে পাট শ‘মিক ইউনিয়নের কর্মী কিসমত-কে ছুরিকাঘাত করে হত্যা এবং হাবিবুর রহমান নামক এক ইউ.সি সদস্যকে গুরুতর ছুরিকাহত করা হয়। তাছাড়া হিন্দুদের আশ‘য় দেওয়ার অভিযোগে স্থানীয় অনেক নেতৃবৃন্দকে হুমকিওয়াদেহয়।৩৮

দাঙ্গার তৃতীয় দিন অর্থাৎ ১৬ জানুয়ারি তারিখেও ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বিভীষিকা অব্যাহত থাকে। তথাকথিত বিহারি মুসলিমদরদীদের আক্রমণেহিন্দু সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি বহু মুসলমান হতাহতহয়।

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

১৬ জানুয়ারি বিহারিদের আক্রমণেনিহত হন আমেরিকার জাতীয় অধ্যাপক এবং নটরডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার নোভাক। তিনি নারায়ণগঞ্জে এক বিপন্ন হিন্দু পরিবারকে উদ্ধার করতে গিয়ে আক্রমণের শিকার হয়ে মারা যান। ৪ দিন পর তার মৃতদেহ নদীতীরে খুঁজে পাওয়া যায় এবং তার হাতঘড়ি ও মোটরসাইকেল তাঁকে হত্যাকারী দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে উদ্ধার করা ৩৯হয়।

এছাড়া ১৬ জানুয়ারি দাঙ্গাকারীদের হামলায়৪ জন মুসলমানসহ ১১ জন নিহত হয়। পাশাপাশি ময়মনসিংহ লাইন দিয়ে ঢাকা গমনাগমনকারী বিভিন্ন ট্রেনের ওপর দুর্বৃত্তরা হামলা ৪০চালায়।এদিকে অশুভ শক্তির মোকাবিলার জন্য ১৬ জানুয়ারি বেসরকারী দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেনের সভাপতিত্বে ১৬ জানুয়ারি ঢাকায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিদের এক সভায় ব্যাপকভিত্তিক এই ”বেসরকারী দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিট্রি গঠন করা হয়।

শেখ মুজিবুর রহমানকে কমিটির আহবায়ক মনোনীত করা হয়। ১১ সদস্য সমন্বিত এ কমিটির বিশিষ্ট সদস্যদের মধ্যে নুরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চেদ্ধধুরী,াজ্জলতফ হোসেন, শাহ আজিজুররহমান, সৈয়দ আজিজুল হক, খাজা য়েরউদ্দিন,খ ডক্টর আলিনুর রাজি, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, বেগম রোকেয়া আনোয়ার, বেগম সুফিয়া কামাল প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ঢাকার ৩৩ নং তোপখানা রোডে কমিটির অফিস ও সাহায্য দান ত্বরান্বিত করার জন্য এক কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়।৪১ গভর্ণর মোনায়েম খান ও কনভেনশন মুসলিম লীগ দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির কাজকে সুনজরে দেখেননি। এমনকি দাঙ্গা কবলিত পুনর্বাসন প্রশ্নেও প্রশাসন শিথিলতা প্রদর্শন৪২দাঙ্গাকরে।

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে ১৭ জানুয়ারি ইত্তেফাক, আজাদ ও সংবাদ পত্রিকায় ”পূর্ব পাকিস্তানয়া রুখিদাঁড়াও’ শিরোনাম একটি আবেদনপত্র প্রকাশ করা হয়।৪৩ এ আবেদনপত্রে সা§প্রদায়িক দুর্বত্তদের হামলায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানে যে ব্যাপক বিশৃৃংখলার সৃষ্টি হয়েছে তার উল্লেখপূর্বক এর প্রতিরোধকল্পে পূর্ব পাকিস্তানের দেশবাসীকে মানবতার জন্য ও পূর্ব পাকিস্তানের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষারজন্য সর্বশক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়াবার আবেদন জানানো হয়।

একইসাথে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি মহল্লায় দাঙ্গা প্রতিরোধ ও সা§প্রদায়িক সহিংসতাকারীদের শায়েস্তা করার জন্য দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করার আহবান জানানো হয়। এর মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জীবন -ওবোনেরমা স§£ম রক্ষার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। ৪*

১৮ জানুয়ারি ইত্তেফাক পত্রিকার রিপোর্ট হতে জানা যায় যে, পুরান ঢাকার ক্ষতিগ্রস্থ গৃহের প্রায় ৯৫% সংখ্যালঘু হিন্দু সাম্প্রদায়ের এবং প্রায় ১ লক্ষ হিন্দু জনগোষ্ঠী ঢাকা শহরে গৃহহীন অবস্থায় বসবাস করছে।৪৪মূলত ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সংখ্যালঘু হিন্দু সাম্প্রদায় ১৪ জানুয়ারি থেকে ১৬ জানুয়ারি দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পাশাপাশি বহু বাধা বিপত্তি সত্বেও নেতৃবৃন্দ সংখ্যালঘু সাম্প্রদায় উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রাখেন। ১৬ জানুয়ারি জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নেতা সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া);.আইডি. জি এন. এ হক এবং স্থানীয় লোকজন যাত্রাবাড়ি ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৭ হাজার সংখ্যালঘু মহিলা পুরুষ ও শিশুকে উদ্ধার করেন। তন¤ধ্যে ৪ হাজার সংখ্যালঘুকে কামরুন্নেসা স্কুলে, ১২ শতকে হরদেত্ত গøাস ফ্যাক্টরীতে এবং বাদবাকী লোকজনকে হাটখোলা রোডের একটি বাড়ীতে স্থান দেওয়া হয়।৪৫

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

১৯ জানুয়ারি থেকে ঢাকা নগরী এবং এর আশেপাশের এলাকার সামগি‘ক অবস্থার‌্যণীয়লক্ষ উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। এদিন সান্ধ্য আইনের মেয়াদ ৬ ঘন্টার জন্য শিথিল করা হয়। এদিন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন আশ‘য় শিবির প্রাদেশিক গভর্ণর আব্দুল মোনায়েম খান পরিদর্শন করেন।

তাছাড়া দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির আহবায়ক শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা ও শহরতলীর আশ‘য় শিবির পরিদর্শন করেন।৪৬শহরের ২১ টি শিবিরে অর্ধলক্ষাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু আশ‘য় গ্রহণ করেছিলেন। ঢাকা যেসব আশ‘য় শিবিরে আশ‘য় প্রার্থীদের স্থান দেওয়া হয়েছিল তা হল: জগন্নাথ কলেজ, জগন্নাথ হল, উইমেন্স হল, পগোজ স্কুল, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল,

*এ আবেদনপত্রটি থেকে দাঙ্গার একটি প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় বিধায় পত্রটি উল্লেখ করা হল: ’সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের ঘৃণ্য ছুরি আজ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানের শান্তÍ ও পবিত্র পরিবেশ কলুষিত করিয়া তুলিয়াছে। ঘাতকের ছুরি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পূর্ববাংলার মানুষের রক্তে লাল হইয়াাছে।উঠিয়দুর্বৃত্তদের হামলায় ঢাকার প্রতিটি পরিবারের শান্তি নিরাপত্তা আজ বিপন্ন।

হিন্দুমাসলমান উভয় সাম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ী পোড়ান হইতেছে। সম্পত্তি বিনষ্ট করা হইতেছে, এমনকি আমির হোসেন চেদ্ধধুরীর মতো শান্তিকামী মানুষদেরও দুর্বৃত্তদের হাতে জীবন দিতে হইতেছে। তাদের অপরাধছিলকি একবার চিন্তা করিয়া দেখুন।

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

গুন্ডারা মুসলমান ছাত্রীনিবাসে হামলা করিয়াছে এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আমাদের -বোনেরমা স§£ম আজ মুষ্টিমেয় কলুষস্পর্শ লাঞ্ছিত হইতে চলিতেছে।এই সর্বনাশা জাতীয় দুর্দিনে আমরা মানবতার নামে, পূর্ব পাকিস্তানের সম্মান ও মর্যাদার নামে দেশবাসীর নিকটআকুল আবেদন জানাইতেছে, আসুন সর্বশক্তি লইয়া গুন্ডাদের রুখিয়া দাঁড়াই, শহরে শান্তি ও পবিত্র পরিবেশ ফিরাইয়া আনি।

পূর্ববাংলার মানুষের জীবনের ওপর এই পরিকল্পিত হামলার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে আমরার পূর্ববাংলার সকল মানুষকে আহবান জানাইতেছি। প্রতি মহল্লায় দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করুন; গুন্ডাদের শায়েস্তা করুন, নির্মূল করুন; পূর্ব পাকিস্তানের-বোনের মাইজ্জত ও নিজেদের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করুন।“ (সূত্র: হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত),বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, ২য় খন্ড, ঢাকা: তথ্য মন্ত্রণালয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ১৯৮২, পৃ. ২১৫।

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

মুসলিম স্কুল, কামরুন্নেসা গার্লস স্কুল, ঢাকেশ্বরী মন্দির, শশী মোহন বসাক লেন, ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুল, সেন্ট গ্রেগরি স্কুল, তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুল, কাজী পাড়া ইত্যাদি।৪৭

দাঙ্গার ৭ম দিনে অর্থাৎ ২০ জানুয়ারি ঢাকার নাগরিক জীবনে স্বাভাবিকতার ছোঁয়া দেখা যায়। তাছাড়া এদিন টঙ্গী, সাভার, নরসিংদী, রুপগঞ্জ, কালিয়াকৈর এসকল দাঙ্গা কবলিত এলাকায় শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান, তাজুদ্দীন আহমদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সফর করেন।৪৮

পাশাপাশি বেগম রোকেয়া আনোয়ার এম.এন এর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সাহায্য করার জন্য ২১ জানুয়ারি ওয়ারী এলাকার টিকাটুলি, হাটখোলা ও কমলাপুর এলাকায় সাহায্য সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করে।৪৯ তাছাড়া এস. হাসান আহমদ এবং শামসুজ্জোহার নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জেক্তশালীশি শান্তি কমিটি গঠিত হয়।

প্রদেশের অন্যান্য স্থানের মধ্যে ভৈরব (ময়মনসিংহ) মাইজদি, ফতুল্লা, ফরিদপুরে শান্তি কমিটি গঠণপূর্বকú্রদায়িকসা§ সম্প্রীতি ও সেদ্ধহার্য্যণœঅক্ষুরাখার শপথ গ্রহণ করা হয়।৫০

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

এদিকে ২১ জানুয়ারি রয়টার সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের বরাত দিয়ে ভারতীয় বেতার পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ১০০০ লোক নিহত হয়েছে বলে সংবাদ প্রচার করে। তাছাড়া নিখিল ভারত আকাশ বাণী হতে প্রচারিত রয়টারের উক্ত খবরে বলা হয় যে, রায়ের বাজারে ৫০০ লোককে হত্যা করা হয়েছে।

আমেরিকার শান্তি বাহিনীর জনৈক নার্সের বরাত দিয়ে উক্ত বেতারে বলা হয়েছে যে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৬০০ মৃতদেহ দেখা গিয়েছে এবং ঢাকার নিকটে তেজগাঁয় ট্রেন থামিয়ে ৪০০ লোককে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে।৫১

যদিও পূর্ব পাকিস্তান সরকার ২২ জানুয়ারি এক পে‘সনোট এ সংবাদকে সম্পূর্ণ আজগুবী ও ভিত্তিহীন বলে আখ্যা দেন। পাশাপাশি এ পে‘সনোটে বলা হয় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে ও প্রদেশের বাদবাকী অংশে শান্তিময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে।৫২

পরবর্তীতে ২৪ জানুয়ারি পি.পি.এ পরিবেশিত আরেকটি সরকারি পে‘সনোটে জানানো হয় যে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও বিভিন্ন জেলার পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ। তাছাড়া নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকায় অধিকাংশ কারখানায় কাজ শুরু হয়েছে এবং ক্রমে ক্রমে শ‘মিকরা কাজে যোগদান করছে।৫৩

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

মূলত ১৯ জানুয়ারি নাগাদ কলিকাতা ও পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গা পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায় বিধায় এর পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানেও দাঙ্গা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। ২৪ জানুয়ারি নাগাদ পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা শান্ত হয়ে যায়। এ সময়ের পর থেকে দাঙ্গা সংক্রান্ত সংবাদ পাওয়া যায়নি যদিও কছুি কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।

পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয় তা প্রথম পর্যায়ে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা থাকলেও পরবর্তীতে তা বাঙা-বিহারিল দাঙ্গায় পরিণত হয়। এ দাঙ্গায় সংখ্যালঘু হিন্দু সাম্প্রদায়ের পাশাপাশি রিদেরবিহা হাতে বাঙালি মুসলমানরাও হতাহত হয়।

আর এ দাঙ্গার পর হতে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু জনগোষ্ঠী ব্যাপক হারে দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়। তথাপি এ দাঙ্গার উল্লেখযোগ্য দিক হল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুন্ডান। এ দাঙ্গা চলাকালে পূর্বপাকিস্তানের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ও প্রগতিশীল জনগোষ্ঠী দাঙ্গা প্রতিরোধে এগিয়ে আসে।

এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন, শেখ মুজিবুর রহমান, আজিজুর রহমান, আতাউর রহমান খান, তফাজ্জল হোসেন, সৈয়দ আজিজুল হক, বেগম রোকেয়া আনোয়ার, বেগম সুফিয়া কামাল প্রমুখ। এ দাঙ্গাবিরোধী গণঅভ্যুন্ডানের মধ্যয়েই একদিকে যেমন পূর্ব পাকিস্তানের শ‘মিক শ্রেণি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপ্লবাত্বক পতাকাকে হাতে নিয়েছিল, তেমনি মেহনতী জনগণের ঐক্যের শিক্ষাকেও গ্রহণ করেছিল।৫৪

তাই ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা ও দাঙ্গাবিরোধী গণঅভ্যুন্ডান বা গণজাগরণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ারঅধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি জাতীয়বাদের পরিবর্তে এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই ১৯৭১ সালে জন¤ নেয় স্বাধীন ও সার্বভেদ্ধম বাংলাদেশ।

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]

 

তথ্যনির্দেশ

১.    নূহ-উল-আলম লেনিন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল),সময় প্রকাশন,

ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ৪৮।

২.    শেখ হাফিজুর রহমান,বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপট,জোনাকী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ১১৭।

৩.    ড. মোহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (১৮৩০-১৯৭১), আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃ. ২৭৭।

৪.    ঞযব “DAWN”, দৈনিক পত্রিকা, করাচি, ২৩ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৫.    দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৬.    ঞযব “DAWN”, দৈনিক পত্রিকা করাচি, ২৩ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৭.    ঝ.ক. ইযধঃঃধপযধৎুধ, এবহড়পরফব রহ ঊধংঃ চধশরংঃধহ/ইধহমষধফবংয, ঐড়ঁংঃড়হ: অ এযড়ংয (চঁনষরংযবৎ), ১৯৮৭, ঢ়. ৭৮

৮.    কালিদাস বৈদ্য, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব,কলকাতা, শংকর কর্মকার পাবলিশার্স, ২০০৫, পৃ. ৮৪।

৯.    দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ জানুয়ারি১৯৬৪।

১০.   জধনরহফৎধহধঃয ঞৎরাবফর (২৩ ঔঁষু ২০০৭), “ঞযব খবমধপু ড়ভ ঃযব চষরমযঃ ড়ভ ঐরহফঁং রহ ইধহমষধফবংয-চধৎঃ-ঠষষ: ইবহমধষর গঁংষরসং ঋরমযঃ ঈড়সসঁৎধষরংস রহ ১৯৬৪”, অংরধহ ঞৎরনঁহব (ডড়ৎষফ ওহংঃরঃঁঃব ভড়ৎ অংরধহ ঝঃঁফরবং) ১২ (৪৯২), জবঃৎরবাবফ ২৭ অঁমঁংঃ ২০১৩.

১১.   দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ জানুয়ারি ১৯৬৪।

১২.   ঐ, ৪ জানুয়ারি ১৯৬৪।

১৩.  ঐ, ৬ জানুয়ারি ১৯৬৪।

১৪.   ড. মাহফুজুর রহমান,বাঙালি জাতীয়বাবাদী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ,বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা ট্রাস্ট, চট্টগ্রাম: বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা, ট্রাস্ট, পৃ. ৩০৪।

১৫.   দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ জানুয়ারি ১৯৬৪।

১৬.   ঐ, ১১ জানুয়ারি ১৯৬৪।

১৭.   ঐ, ১২ জানুয়ারি ১৯৬৪।

১৮.  ঐ, ১২ জানুয়ারি ১৯৬৪।

১৯.   হবংি.ননপ.পড়.ঁশ/ড়হঃযরংফধু/যর/ফধঃবং/ংঃড়ৎরবং/লধহঁধৎু১৩/হবংিরফ-৪০৯৮০০০/৪০৯৮৩৬৩:ংঃস

২০.  দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ জানুয়ারি ১৯৬৪।

২১.   ঐ, ১২ জানুয়ারি ১৯৬৪।

২২.   ঐ, ১৪ জানুয়ারি ১৯৬৪। ৮৬   পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক(১৯৬৪):দাঙ্গা সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা

২৩.  ঐ, ১৪ জানুয়ারি ১৯৬৪।

২৪.   ঐ, ১৪ জানুয়ারি ১৯৬৪।

২৫.   ঐ, ১৪ জানুয়ারি ১৯৬৪।

২৬.  ঐ, ১৫ জানুয়ারি ১৯৬৪।

২৭.  ঐ, ১৫ জানুয়ারি ১৯৬৪।

২৮.  ঐ, ১৫ জানুয়ারি ১৯৬৪।

২৯.   ঐ, ১৫ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৩০.  ঐ, ১৫ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৩১.  ঐ, ১৫ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৩২.  ঐ, ১৫ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৩৩.  ড. মোহাম্মদ হান্নান,প্রাগুক্ত,পৃ. ২৭৭।

৩৪.  ড. মাহফুজুর রহমান,প্রাগুক্ত,পৃ. ৩০৪।

৩৫.  দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৩৬.  ঐ, ১৬ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৩৭.  ঐ, ১৬ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৩৮.  ঐ, ১৬ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৩৯.  জধনরহফৎধহধঃয ঞৎরাবফর, ড়ঢ়. পরঃ.

৪০.  দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৪১.   ঐ,১৭ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৪২.   অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি (১৯৪৫ থেকে ৭৫), ঢাকা: খোশরোজ কিতাব মহল লিমিটেড, ২০০২, পৃ. ২৫৯।

৪৩.  ড. মো. মাহবুবর রহমান,বাংলাদেশের ইতিহাস ১৯৪৮-৭১, ঢাকা: সময় প্রকাশন, ২০০০, পৃ. ১৬৭।

৪৪.   দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৪৫.   ঐ, ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৪৬.  ঐ, ২০ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৪৭.  ঐ, ২০ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৪৮.  ঐ,২১ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৪৯.   ঐ, ২১ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৫০.  ঐ, ২২ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৫১.   ঐ, ২৩ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৫২.   ঐ,২৩ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৫৩.  ঐ, ২৫ জানুয়ারি ১৯৬৪।

৫৪.   রণেশ দাশ গুপ্ত, ”দুর্দিনের সাথীকে অভিবাদন্র,মইনুল হোসেন (সম্পাদিত)অবিস্মরণীয় মানিক মিয়া, ইত্তেফাক প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা, পৃ. ২৩।

[ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা ]