বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। কৃষির পাশাপাশি পশুপালন আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুধ, ডিম, মাংস, চামড়া—এসব পণ্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ এবং জাতীয় অর্থনীতির শক্তিশালী খাত। তবে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, রোগ-ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং পশুসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি।
বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (BTEB) এই চাহিদা পূরণের লক্ষ্যেই চালু করেছে “সার্টিফিকেট ইন অ্যানিমেল হেলথ অ্যান্ড প্রোডাকশন” কোর্স।
সার্টিফিকেট ইন অ্যানিমেল হেলথ অ্যান্ড প্রোডাকশন
কোর্সের উদ্দেশ্য
এই সার্টিফিকেট প্রোগ্রামের মূল লক্ষ্য হলো:
- শিক্ষার্থীদের পশুপালন ও প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় দক্ষ করে তোলা।
- প্রাণিসম্পদের স্বাস্থ্যসেবা ও রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করা।
- দুধ, ডিম, মাংস ও অন্যান্য প্রাণিজ পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও ব্যবহারিক দক্ষতা প্রদান।
- ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের খামারিকে টেকসই ও লাভজনক ব্যবসায় রূপান্তরে সহায়তা করা।
- জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রাণিসম্পদ খাতকে আরও শক্তিশালী করা।
কোর্সের সময়কাল ও কাঠামো
- সময়কাল: সাধারণত ১ বছর মেয়াদী সার্টিফিকেট প্রোগ্রাম।
- শিক্ষাগত যোগ্যতা: এসএসসি/সমমান উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা এ কোর্সে ভর্তি হতে পারে।
- কোর্সের ধরন: তাত্ত্বিক শিক্ষা + ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ + ফিল্ড ভিজিট।
পাঠ্যসূচির বিষয়বস্তু
এই সার্টিফিকেট কোর্সের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত থাকে—
- পশু শারীরবিদ্যা ও শারীরতত্ত্ব – পশুর শরীরের গঠন, কার্যপ্রণালী ও রোগ নির্ণয়ের মৌলিক ধারণা।
- পশু পুষ্টি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা – পশুর খাবারের মান, খাদ্যতালিকা প্রণয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কৌশল।
- অ্যানিমেল হেলথ কেয়ার – সাধারণ ও জটিল রোগ শনাক্তকরণ, ভ্যাকসিন প্রয়োগ, প্রাথমিক চিকিৎসা।
- ডেইরি ও পোল্ট্রি প্রোডাকশন – গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি পালন ও উৎপাদন বাড়ানোর আধুনিক কৌশল।
- প্রজনন ও প্রজনন প্রযুক্তি – কৃত্রিম প্রজনন, ব্রিড উন্নয়ন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা।
- অ্যানিমেল ফার্ম ম্যানেজমেন্ট – ক্ষুদ্র খামার থেকে বড় খামার পরিচালনার দক্ষতা।
- পশু কল্যাণ ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা – পশু কল্যাণ নিশ্চিতকরণ ও পরিবেশবান্ধব খামার গড়ে তোলা।
- প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং – সরকারি ও বেসরকারি খামার, ভেটেরিনারি ক্লিনিক ও প্রাণিসম্পদ অফিসে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ।
শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ
এই সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্ন করার পর শিক্ষার্থীরা—
- স্থানীয় পর্যায়ে ভেটেরিনারি টেকনিশিয়ান বা অ্যানিমেল হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করতে পারবেন।
- দুধ, মাংস, ডিম উৎপাদনকারী খামারে চাকরির সুযোগ পাবেন।
- নিজস্ব খামার গড়ে তোলার মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেন।
- সরকার, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবেন।
- ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা বা ডিপ্লোমা/ডিগ্রি ইন ভেটেরিনারি সায়েন্স, ডেইরি সায়েন্স, পোল্ট্রি সায়েন্স ইত্যাদিতে ভর্তি হয়ে দক্ষতা আরও বাড়াতে পারবেন।
কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা
বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটিরও বেশি গবাদি পশু ও প্রায় ৩৪ কোটি হাঁস–মুরগি রয়েছে। এই বিশাল পশুসম্পদকে যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করার জন্য প্রয়োজন অসংখ্য দক্ষ জনবল।
- সরকারি সুযোগ: প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস, ভেটেরিনারি হাসপাতাল।
- বেসরকারি সুযোগ: ডেইরি খামার, পোল্ট্রি ফার্ম, পশুখাদ্য কোম্পানি, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান।
- উদ্যোক্তা সম্ভাবনা: নিজস্ব খামার স্থাপন, ভেটেরিনারি ক্লিনিক বা প্রাণিসম্পদ কনসালটেন্সি।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব
- অটোমেশন ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাণিসম্পদ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে।
- শিক্ষিত ও দক্ষ যুবসমাজ গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।
- দেশীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং বিদেশে মাংস, দুগ্ধজাত পণ্য ও অন্যান্য প্রাণিজ সামগ্রী রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সার্টিফিকেট ইন অ্যানিমেল হেলথ অ্যান্ড প্রোডাকশন কোর্স কেবল একটি সার্টিফিকেট নয়; এটি হলো গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার, বেকারত্ব দূর করার এবং টেকসই উন্নয়নের এক শক্তিশালী হাতিয়ার।
এই কোর্সের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কেবল চাকরির উপযোগী হবেন না, বরং নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে সমাজে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন। ফলে এই সার্টিফিকেট কোর্সকে বলা যায়, ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের অন্যতম ভরসা।